যেভাবে কয়েকটি সংখ্যার মানে বদলে গেল-
৪০ মানে -- পঞ্চাশ এখনও যার দশ ঘর দূরে৷ আর পঞ্চাশ? সে তো হাফ-সেঞ্চুরি৷ “এক' মানে হল সবকিছুর শুরু৷ কেউ কেউ অবশ্য বলেন, সব কিছু শুরুর মূল দাবিদার “শূন্য'৷
এ সবই সংখ্যাগুলোর নিজস্ব ও স্বাভাবিক অর্থ৷ এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই৷
আচ্ছা, একুশ মানে কী? অথবা ৫২? বা ৬৯, ৭১? কিংবা ৯০? মনে হতেই পারে এই অনর্থক প্রশ্নের মানেটা কী? এসব ও তো কিছু সংখ্যা-ই!
হুমম৷ খুবই সত্যি কথা৷ এরাও কয়েকটি সংখ্যাই বটে৷ তবে এদের অর্থ কেবল কিছু সংখ্যাই নয়, আমাদের কাছে এদের অর্থ আরও অনেক অনেক ব্যাপক৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশে জন্মেছি বলেই কয়েকটি সংখ্যার মানে আমাদের জীবনে আশ্চর্যজনকভাবে পাল্টে গেছে৷
আমরা বাংলাদেশি বলেই, বাহান্ন বা একুশ শুনলে, ৫-এর পরে ২ অথবা ২-এর পরে ১ বসিয়ে দুটো সংখ্যাই কেবল মনে হয় না আমাদের কাছে -- ৫২ বা ২১ মানে -- আমাদের কাছে -- নিজের ভাষার জন্যে বুক ভরা ভালবাসা৷ যে ভালবাসার টানেই আমাদের ভাষা-শহীদদের আত্মত্যাগ৷
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির কথা বাঙালি মাত্রেরই জানা৷ আর কিছু নয়, নিজের ভাষার কথা বলবার অধিকারও যে প্রাণ দিয়ে আদায় করে নিতে হবে, এই দিনটির আগে কেউ কি তা কল্পনাও করেছিলেন? এই যে আমি এখন অবলীলায় গড় গড় করে বাংলায় লিখে চলছি, খেলার মাঠে নিজের প্রিয় দলকে চিৎকার করে “সাবাস সাবাস' বলে উৎসাহ দিচ্ছি, অথবা বন্ধুদের সঙ্গে দিচ্ছি প্রাণ খুলে আড্ডা৷ গলা ছেড়ে কখনও গেয়ে চলেছি বুকের গভীর থেকে উঠে আসা গান -- “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ....'৷ অথবা জ্বরার্ত কণ্ঠে কখনও অস্ফুটে আমার ডেকে ওঠা -- “মা ...'! এ সবেরই পেছনে ঐ একটি দিনেরই পূর্ণ অবদান৷
এরপর ৬৯-এর গণ-অভ্যুথান৷ ভাষার অধিকার আদায়ের পর আমাদের স্বাধীনতার দাবিকে আরও জোরালো করা হল যে ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে, ১৯৬৯ এই হয়েছিল তা৷ পরাধীনতা ভেঙে ফেলে, নিজেদের একটি ভূখণ্ডের স্বপ্নের শুরুও এই সময়েই৷
তারপর, ৭১৷ চোখ বুজে শুধু ৭১ বললেই মাতৃভূমির কথা মনে পড়ে যায় আমাদের৷ ১৯৭১ সালটিই এদেশের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়৷ ২৫ মার্চ রাতের নৃশংস গণহত্যা, তারপর ২৬শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা৷ এরপর একেকটি সংগ্রামমুখর দিনের মধ্য দিয়ে -- অনেক আত্মত্যাগ আর বিসর্জনের নয় মাস পর -- সেই ৭১-এরই ডিসেম্বরে অর্জিত হয় আমাদের বিজয়৷ যে বিজয়ের ফলে বিশ্ব-মানচিত্রে আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে জায়গা করে নিয়েছি৷ স্বাধীন একটি দেশ হিসাবে আমাদের অস্তিত্বের ঘোষণা আর তার বাস্তবায়ন হয়েছিল ১৯৭১-এ৷ এ কারণেই মনে হয় যেন -- ৭১ সংখ্যাটিই আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে আছে৷
৯০-এরও রয়েছে আলাদা তাৎপর্য৷ স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনের তরতাজা স্মৃতিময় ১৯৯০-এর উত্তাল দিনগুলো৷ আরও একবার পুরো দেশের মানুষের মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া! অবশেষে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আবারও আমাদের মুক্তি৷
এমনি করে, ২১, ৫২, ৭১ বা ৯০, এই সাল বা তারিখগুলো কয়েকটি সংখ্যার রূপ ধরে আমাদের কাছে অন্যরকম মানে নিয়ে আসে৷ অন্য যে কোনও সংখ্যার চেয়ে তাই এ সংখ্যাগুলৈ আমাদের কাছে বেশি আপন মনে হয়, বেশি মহিমান্বিত৷ কালো কলম দিয়ে কালো হরফে লিখছি ওদের, তবু যেন মনে হয়, তাদের র ং আসলে লাল -- রক্তেভেজা লাল৷
এ সংখ্যাগুলো প্রতিবার উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গীত হয়ে বেজে উঠে আমাদের মনে৷ প্রতিবার লিখবার সময় দেখতে পাই -- আরও বেশি সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে উঠেছে যেন ওরা৷ যতবারই ভাবি ওদের; ভাষা হয়ে, ভালবাসা হয়ে রক্তের মাঝে চঞ্চলতা বাড়ায় এরা৷ প্রতিবার শুনতে গিয়ে তাই মনে হয়, আলাদা করে কিছু সংখ্যা নয় -- যেন একটিই শব্দ শুনছি বারে বারে -- “বাংলাদেশ'!
আজ তাই এত বছর পরেও আমরা, নতুন প্রজন্মের গর্বিত মানুষেরা, বিজয়ের এই মাসে সেই বীর শহীদদেরকে বুকের গভীর থেকে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা -- যাদের কারণে নিজের ভাষাকে আপন করে নিতে পেরেছি আমরা৷ জন্মের সংগে সংগেই পেয়েছি একটি পতাকা, নিজের একটি দেশ, আর দেশেরই প্রতিধ্বনি করা ভালোবাসাময় কয়েকটি সংখ্যা৷
-----------
২০০৪ এর ডিসেম্বরে লেখা।
প্রথম প্রকাশ: বাংলালাইভ।
ছবি: সূত্র।