শেকসপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে


সেই সব দিনে আমার কাছে বই কেনার মত কোনো টাকা থাকত না। আমি তাই শেকসপিয়র অ্যান্ড কোম্পানির রেন্টাল লাইব্রেরি থেকে ভাড়া করে এনে বই পড়তাম। ১২ রু-ডে-ল'ওডিওন রাস্তায় ছিল এই বইয়ের দোকান আর লাইব্রেরিটা, সিলভিয়া বিচ সেটা চালাত। দোকানের জায়গাটা বেশ খোলামেলা, তাই ঠান্ডা বাতাসের আনাগোনা থাকলেও সেটা তবু ভরে থাকত মানুষের আনন্দ আর উষ্ণতায়। শীতকালে বড় একটা স্টোভ জ্বালিয়ে দেয়া হতো দোকানের সামনে, ভেতরে টেবল আর শেলফভর্তি অনেক বই সাজানো। নতুন বইগুলো রাখা হতো জানালার কাছে, আর দেয়াল জুড়ে লাগানো থাকত জীবিত এবং মৃত বিখ্যাত সব লেখকের ছবি। ছবিগুলো স্ন্যাপশটের মত দেখতে, মৃত লেখকদেরও সেগুলোয় বেশ জীবন্ত দেখাত। সিলভিয়াও ছিল জীবনীশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ। তার মুখের গঠন ছিল ধারালো; চোখগুলো বাদামী রঙের, ছোট্ট কোনো প্রাণীর চোখের মতই জ্বলজ্বলে, আর কমবয়েসী মেয়েদের মত ছটফটে। সিলভিয়ার মাথার ঢেউ খেলানো বাদামী চুল সুন্দর কপালটা থেকে টেনে এনে একেবারে মাথার পেছন পর্যন্ত শক্ত করে বাঁধা থাকত। আর মাথার পাশে কানের পেছন পর্যন্ত যত্ন করে কাটা ঘন চুল ছুঁয়ে থাকত তার ভেলভেট জ্যাকেটের বাদামী কলার। খুব সুন্দর আর সুগঠিত পা ছিল সিলভিয়ার, আর সে নিজে ছিল ভীষণ মায়াবতী। কৌতুক পছন্দ করত সে, গসিপও। সারাক্ষণই আনন্দে মেতে থাকত সিলভিয়া। আমার চেনা মানুষদের মধ্যে আর কেউ সিলভিয়ার মত এমন সুন্দর করে কথা বলত না আমার সাথে।


প্রথম যেদিন আমি এই লাইব্রেরিটায় যাই, স্বভাবতই বই ধার নেয়ার জন্যে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না আমার কাছে। আমি খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম, কিন্তু সিলভিয়া বললো, এখনি টাকা দেয়ার কোনো দরকার নেই, পরে কখনও দিলেও চলবে। এই বলে সে আমার নামে একটা লাইব্রেরি কার্ড তৈরি করে দিল। তারপরে বললো সেদিনই আমি যতগুলো ইচ্ছে বই ধার নিতে পারি।

সিলভিয়া আমাকে চিনত না, আমাকে বিশ্বাস করার আলাদা কোনো কারণ নেই তার। তাছাড়া আমি যে ঠিকানাটা দিয়েছি ওকে, ৭৪ রু-কার্ডিনাল-লেময়েন, এটা বেশ গরীব একটা এলাকা। কিন্তু সেসব কিছুই কোনো ভাবান্তর ঘটাতে পারল না তার, বরং সিলভিয়া খুবই আন্তরিকতা দেখাল আমাকে। আমি দেখতে পেলাম, তার পেছনে মেঝে থেকে দেয়াল পর্যন্ত শেলফের পর শেলফ জুড়ে শুধু বই আর বই।

আমি শুরু করলাম তুর্গেনেভের বই দিয়ে। সাথে নিলাম 'আ স্পোর্টসম্যানস স্কেচেস' এর দুটা ভলিউম, আর ডি এইচ লরেন্সের শুরুর দিকের কোনো একটা বই, সম্ভবত 'সনস অ্যান্ড লাভারস'। সিলভিয়া বললো চাইলে আমি আরও বই নিতে পারি। আমি তখন 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' এর কনস্টান্স গারনেট এর এডিশনটাও নিলাম, আর নিলাম দস্তয়েভস্কির 'দ্য গ্যাম্বলার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ'।

'এই সবগুলো বই শেষ করতে গেলে তুমি সহসাই আবার লাইব্রেরিতে আসার সুযোগ পাবে না,' সিলভিয়া বললো।

'আমি শীঘ্রি টাকা দেয়ার জন্যে আবার আসব,' আমি বললাম। 'কিছু টাকা আছে আমার কাছে, আমার ফ্ল্যাটে।'

'না, না, আমি সেটা বলতে চাইনি,' সে বলে ওঠে। 'তোমার যখন সুবিধা তখনি টাকা দিয়ে যেও, কোনো সমস্যা নেই।'

'আচ্ছা, জয়েস কখন আসে লাইব্রেরীতে?' আমি জিজ্ঞেস করলাম।

'জয়েস এলে সাধারণত একেবারে শেষ বিকেলের দিকে আসে,' সে বলে, 'তোমাদের দেখা হয়নি কখনো?'

'মিশো রেস্তোরাঁয় একবার দেখেছি আমরা তাঁকে, পরিবারের সাথে বসে খাচ্ছিল।' আমি বললাম। 'অবশ্য খাওয়ার সময় কাছে গিয়ে কথা বলাটা ঠিক ভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে না। তাছাড়া মিশো খুব দামী রেস্তোরাঁও বটে।'

'তুমি কি বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া করো?'

'ইদানিং তাই করছি,' আমি বলি,' আমাদের কুক বেশ ভালো রান্না করে।'

'তোমাদের ধারে কাছে তেমন ভালো কোনো রেস্তোরাঁ নেই বোধ হয়, তাই না?'

'না। কিন্তু তুমি জানলে কী করে?'

'লারবুড আগে থাকত ওখানে,' সিলভিয়া বললো। 'এই একটা ব্যাপার ছাড়া জায়গাটা তার বেশ ভালোই লাগত।'

'হ্যাঁ, সস্তায় ভালো খেতে চাইলে দ্য প্যান্থিওনের কাছের জায়গাটায় যেতে হয় ওখান থেকে।'

'আমি জায়গাটা চিনি না। আমরা অবশ্য বাড়িতেই খাই। তোমার বউকে নিয়ে অবশ্যই আসবে আমাদের বাড়িতে।'

'আগে দেখো সত্যিই আমি তোমার টাকা পরিশোধ করি কিনা!' বললাম আমি। 'অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।'

'খুব দ্রুত সব পড়ে শেষ করে ফেলো না আবার,' সে বলে।

রু কার্ডিনাল লেময়েনে আমাদের বাড়িটা আসলে ছিল একটা দুই রুমের ফ্ল্যাট। সেটায় গরম পানির কোনো ব্যবস্থা নেই, বাড়ির ভেতরে কোনো টয়লেটও ছিল না। তার বদলে ছিল একটা অ্যান্টিসেপটিক কনটেইনার। মিশিগানের আউটহাউজে বড় হওয়া মানুষদের জন্যে এটা আসলে কোনো ব্যাপারই না। বাড়ির ভিউ ভালো হলে, আর বিছানার ওপরে একটা স্প্রিং লাগানো চমৎকার ম্যাট্রেস থাকলে আর কিছুই লাগে না। সেই সাথে দেয়ালে যদি ঝোলানো থাকে আমাদের পছন্দের সব ছবি, সব কিছু মিলে থাকার জন্যে এটা একটা দারুণ জায়গা হয়ে যায়। হাতে সেদিন অনেকগুলো বই নিয়ে বাড়ি পৌঁছালাম। বউকে বললাম লাইব্রেরিটার কথা। বললাম, কী চমৎকার একটা বইয়ের দোকান খুঁজে পেয়েছি।

'কিন্তু টাটি, তোমার আজ বিকেলেই সেখানে গিয়ে টাকা দিয়ে আসা উচিত,' আমার বউ বলে।

'অবশ্যই,' আমি বললাম। 'আমরা দুজনেই যাই চলো। তারপরে ফেরার পথে আমরা নদীর পার ধরে হেঁটে আসব।'

'ঠিক। চলো আমরা রু ডে সাইনের পাশ ধরে হেঁটে আসি, আর সবগুলো গ্যালারি আর দোকানে ঢুঁ মেরে আসি।’

‘অবশ্যই। যেখানে খুশি আমরা হাঁটতে যেতে পারি। নতুন কোনো ক্যাফেতে গিয়ে থামব আমরা, যেখানে আমাদের কেউ চেনে না, আমরাও কাউকে চিনি না। সেখানে গিয়ে একটা কিছু ড্রিংক করতে পারি আমরা।'

'একটা না, আমরা দুটা ড্রিংক করবো।'
'হ্যাঁ, তারপরে অন্য কোথাও গিয়ে একটা কিছু খাব।'

'না, ভুলে যেও না আমাদেরকে আগে লাইব্রেরিতে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতে হবে।'

'তারপরে আমরা বাড়ি ফিরে আসব, আর এখানে বসে দুজনে ডিনার করবো। ডিনারে চমৎকার সব খাবার থাকবে, সাথে থাকবে ব্যুন ওয়াইন। মনে করে দিও, ফেরার সময় এই ওয়াইন কিনে আনতে হবে সামনের কো-অপারেটিভটা থেকে। আমাদের জানালা দিয়ে দেখ ওদের জানালা দেখা যায়, সেখানে ব্যুনের দামও লেখা আছে। তারপরে কিছুক্ষণ আমরা বই পড়ব একসাথে, তারপরে বিছানায় গিয়ে প্রেম করবো।'

‘আমরা আর কখনো অন্য কারো সাথেই প্রেম করব না, শুধু দুজন দুজনের সাথে।'

'হ্যাঁ, শুধু আমরা দুজনে।'

'ওহ, কী দারুণ একটা সময় কাটবে! চল, এখনি আমরা লাঞ্চ করে ফেলি।'

'খুবই খিদে পেয়েছে আমার,' বললাম আমি। 'ক্যাফেতে বসে লিখতে লিখতে আমি কেবল এক কাপ কফি খেয়েছি।'

'লেখা কেমন এগোলো, টাটি?'

'মনে হয় ভালোই হয়েছে, দেখা যাক। লাঞ্চে কী খাচ্ছি আমরা?'

'ছোট ছোট র‍্যাডিশ, আর ম্যাশড পটাটো-র সাথে ফোয় ডে ভ্যু, আর একটা এনডিভ স্যালাড। সাথে অ্যাপল টার্ট।'

'আমাদের কাছে এখন দুনিয়ার সব বই আছে। কোথাও ট্রিপে যাওয়ার সময় চাইলে আমরা সব বই সাথে করে নিয়ে যেতে পারব!'

'কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে?'

'অবশ্যই ঠিক হবে।’

'ওর কাছে হেনরি জেমসের বই আছে?'

'অবশ্যই আছে।'

'বল কী!' সে বলে, 'আমাদের কী ভাগ্য যে এ জায়গাটার খোঁজ পেলে তুমি।'

'আমাদের ভাগ্য সবসময়ই ভালো,' আমি বললাম। কিন্তু মনে মনে ‘টাচ উড' বলে নিয়ে কোনো একটা কাঠে টোকা দিতে ভুলে গেলাম বোকার মত। যদিও টোকা দেয়ার জন্যে ঘরভর্তি কাঠের জিনিসপত্র ছড়িয়ে আছে।


(আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘আ মুভেবল ফিস্ট’ বই থেকে/ অনুবাদ - তারেক নূরুল হাসান)

ছবি- Sylvia Beach and Ernest Hemingway in front of her bookshop, Shakespeare and Company. Copyright Estate of Sylvia Beach. From the Collection of Sylvia Beach, Paris.

Popular posts from this blog

আরেকটিবার-

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy