গদ্য ১ - প্যাচাল

প্যাঁচাল


এইচএসসির পর কোচি ংকরতে আমরা যারা " ফরেইনার ' অর্থাত্ ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় আসি,থাকার জন্য " এক টুকরো ' জায়গার খোঁজে আমাদের যে কি ঝক্কি পোহাতে হয় সে শুধু আমরাই জানি৷ ঐ যে বলে না, " কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে৷৷৷ ' সত্যিই সে এক বিষময় যাতনা!

তো ধন নয়,মান নয়,এতটুকু বাসা ... থুক্কু বাসা নয়,মেস৷ সেই মেস খোঁজার জন্য আমি আর আমর বন্ধু চপল পুরো ফার্মগেট এলাকা চষে বেড়াচ্ছি৷ ফার্মগেট কেন? কারণ,কোচি ংসেন্টারগুলো সব ওখানে গিয়েই " উত্পাদিত ' হয়েছে৷ কিন্তু কোথাও ভ্যাকেন্সি নাই৷ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করি; কিন্তু কাজ হয় না৷ পরে ঠিকানা টুকে নিয়ে হাঁটা দিলাম৷ যেখানেই দেখি " টু-লেট ' অথবা " রুম ভাড়া দেয়া হবে ' - সেখানেই একবার করে ঢু ঁমারি৷ কিন্তু হায়! বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হয় আরও আজব অভিজ্ঞতা৷ প্রথমেই জিজ্ঞেস করে " আপনারা কি স্টুডেন্ট?'

ঘাড় কাত করে স্টুডেন্ট হওয়ার অপরাধ স্বীকার করি৷ হ্যা,ঁতাই৷ মেস খুঁজে বেড়াতে হয়েছে এমন ছাত্র মাত্রই জানেন ঢাকা শহরে " স্টূডেন্ট ' হওয়া বিরাট অপরাধ৷

" না ভাই,আমরা স্টুডেন্টকে ভাড়া দেই না৷ '

হতাশ হই এব ংঅবাক লাগে৷ পৃথিবীতে এমন কোন " শালার ব্যাটা ' আছে যে " স্টুডেন্ট ' না থেকে সরাসরি চাকরি পেয়ে গেছে!! তবু হাল ছাড়লে তো চলবে না৷ খুঁজে যাই৷ বিচিত্র সব বাড়ি,বিচিত্র সব ব্যাপার স্যাপার৷

একটা বাসায় গেলাম,টিনের ঘর ভাড়া দেবে৷বাড়িওয়ালার অসীম দয়া- আমরা "স্টুডেন্ট ' জেনেও তিনি রাজি হয়েছেন! বেশ ভাল৷ সবই ঠিক আছে কিন্তু লাগোয়া কোন টয়লেট নেই৷ সেট হল ভেতর বাড়িতে৷ মানে বাড়িওয়ালার টয়লেট৷ তাতে কি? ঘর পেয়েছি এই ঢের৷ কিন্তু না,শর্ত আছে৷ তা হল রাত দশটার পরে সামনের গ্রিলে তালা দেয়া হবে তাই ভেতরের টয়লেটে যাওয়া যাবে না৷

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল৷ কি আচানক কথা৷ মানুশের টয়লেটের কি কোন ঠিক-ঠিকানা আছে নাকি! প্রকৃতির খেয়াল৷ কখন যে সে " ডাক ' দিবে আর কখন আমাদের বদনা হাতে দৌড় দিতে হবে তা আগে থেকে কি করে বলব! পেট তো জানবে না যে রাত দশটার পর টয়লেট বন্ধ!

তাই " ইচ্ছা নাহি হয় হায়,তবু৷৷৷

অন্য বাসা খুঁজতে বের হলাম৷

স্টুডেন্টদের ব্যাপারে এত আপত্তি কেন? এক ঠোঁট কাটা বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিলেন," ওদের কোন গ্যারান্টি থাকে না,কখন যে টাকা না দিয়েই চলে যায় তার ঠিক নেই৷ '

আমরা তখন তাকে তেল দেয়া শুরু করলাম৷ আমাদের পূর্ব ইতিহাস জানালাম, কলেজ থেকে দেয়া " চারিত্রিক ' সনদপত্র দেখালাম, পৃথিবীর কোন প্রান্তেই যে বহু খুঁজেও আমাদের মত " ভদ্র ' ," শান্ত ' , এব " ংভাল ' ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না তা-ও বোঝালাম৷

এক পর্যায়ে থাকতে না পেরে চপল বলল৷৷৷ " দরকার হলে আপনি আমার মেইন মার্কশীট জমা রাখেন৷৷৷ ৷ '

কিন্তু শিকে ছিড়ল না৷ মেইন মার্কশীটের মর্ম ঐ পাষাণ কেমন করে বুঝবে!

খুঁজতে খুঁজতে এমনি এক হতাশ দুপুরে গিয়ে উপস্থিত হলাম এক একতলা বাড়ির সামনে৷ " টু-লেট ' লেখা দেখে গেট ধাক্কাতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সুবহানাল্লাহ সাক্ষাত্ এক ডানাকাটা পরী! আমাদের বুকের ভেতরের ছোট্ট হার্ট দুটো ততক্ষনে টগবগে দু'খানা অ্যারাবিয়ান ঘোড়া হয়ে ছুটতে শুরু করেছে৷

" কাকে চাই '

জানালাম৷৷৷ বাড়িওয়ালাকে চাই৷

" দাঁড়ান,আব্বাকে ডেকে দিচ্ছি৷ '

খানিক পরে " আব্বাজান ' এলেন৷ এসেই উনি প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন," আপনারা কি ব্যাচেলার ? '

ঘোড়া নয়৷ হার্ট ততক্ষনে জেট ইনি হয়ে উড়ছে আকাশে৷ কি শুভক্ষনেই না এসেছি এখানে৷ ঘরে এত সুন্দর " মেয়ে ' আর উনি খুঁজছেন ব্যাচেলার - আমরা দু'জনে সবেগে উপর-নিচে মাথা ঝাঁকাতে লাগলাম ৷ এক মুহুর্তের জন্যে মনে হল , ছিঁড়ে না যায় আবার৷

বাড়িওয়ালা বললেন," সরি, আমি ব্যাচেলারদের ভাড়া দেই না৷৷৷ ৷ '

জেট ইন্জিন ক্র্যাশ করল! দু'জনেই আবার মাটিতে ফিরে এলাম৷

আর কি! আবার খোঁজা শুরু হল৷ এরকম কয়েকটা জায়গায় ব্যাচেলার হওয়ার দায়ে ভাড়া না পেয়ে ঠিক করলাম আজই বাবা-মাকে পত্র লিখব- " তোমাদের ছেলের জন্য একজন "পুত্রবধূ' এই মুহুর্তে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ যেমন করেই পারো৷৷৷ '

অবশেষে পেলাম৷ না, বাবা-মার জন্য পুত্রবধূ না,আমাদের দুই বন্ধুর জন্য একটা মেস৷ রাজাবাজারে সেটা ভুপেন আংকেলের মেস৷ ছয়তলা বাড়ির পাঁচতলায় মেস ভাড়া দিয়ে রেখেছেন৷ বসে বসে ইনকামের এমন সুন্দর প্রসেস আর নাই৷ মনে মনে নিজের এইম ইন লাইফ ঠিক করে ফেললাম৷ ঢাকা শহরে একটা মেসবাড়ির মালিক হতে হবে যে করেই হোক৷

মেস পেতেই আরেক বন্ধু এসে হাজির হল, তৌহিদ৷ তিন বন্ধু মিলে একগাদা জিনিসপত্র কিনে রুম ঠিক করলাম৷ সাজিয়ে-গুছিয়ে ভাল করে তাকিয়ে দেখি- এক "বউ' ছাড়া আর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসই সেখানে উপস্থিত৷

রুম ছিল বটে একখানা৷ ঘুপচি অন্ধকার৷ এটা কি রোদভরা দিন না অমাবস্যার রাত রুমে বসে বোঝার কোন উপায়ই নেই৷
মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে ঘড়িতে ছয়টা বজে দেখে দ্বিধায় পড়ে যেতাম,কোন "ছয়',ভোর না সন্ধ্যা?

বারান্দা আছে অবশ্য একটা৷ তবে সেখানে দাঁড়ালে আকাশ নয়,পাশের বাড়ির দেয়াল চোখে পড়ত৷ সেটা এতই কাছে- , রোদ দূরে থাক,বৃষ্টি পড়লেও টের পেতাম না৷

তেলাপোকার ছড়াছড়ি,মেসের অখাদ্য-কুখাদ্য,এসব নিয়ে ভালই ছিলাম৷ কোচি ংশেষ করে অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে রুমে এসে শুয়ে পড়তাম৷

ফ্লোরের উপর বিছানো তোশক; তার ওপর চিটচিটে চাদর,সেখানেই শুয়ে হাতটাকে বালিশ বানিয়ে,সদ্য কেনা সিলি - ংফ্যানটার ঘুরতে থাকা পাখাগুলোর দিকে তাকিয়ে,তিনজনেই; কি জানি কার কথা ভেবে হেঁড়ে গলায় এক সঙ্গে গেয়ে উঠতাম- " চন্দন পালংকে শুয়ে,একা একা কী হবে,জীবনে তোমায় যদি পেলাম না৷ '

*********************

দৈনিক যুগান্তরের সাপ্তাহিক ফান ম্যাগাজিন "বিচ্ছু'-তে প্রকাশিত৷

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-