আর্থ আওয়ারঃ প্রিয় পৃথিবীর জন্যে একটি ঘন্টা


আর্থ আওয়ার-এর মূল ধারণাটা এরকমই। প্রিয় পৃথিবীর জন্যে একটা কিছু করা। আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে থেকেই এমন কার্যকরী কোন পদক্ষেপ; যেটা আপাত দৃষ্টিতে খুব সামান্য হতে পারে, কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে এর অবদান হয়ে যাবে অনেক বড়।
পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে গেলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে যে দেশগুলো, তাদের তালিকায় বাংলাদেশ যে অনেক উপরের দিকে, এটা আজকের নতুন কোন খবর নয়। কাগজ কলমের হিসাব অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি আর এক মিটার বেড়ে যায়, তাহলে আমাদের ছোট্ট দেশটার পনের ভাগ এলাকাই ডুবে যাবে পানির নীচে। ঘরহারা হবে প্রায় ১৩ মিলিয়ন মানুষ। এই হিসাবের বাইরে এরকম দুর্যোগে আর কি কি হতে পারে, সিডরের পরের গত এক মাসে আমরা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। মাঠের শস্য ভেসে যায় পানিতে,ক্রমশ বাড়তে থাকা মৃত মানুষের অংক আমাদের কাছে হয়ত কিছু সংখ্যা, কিন্তু অনেকের জন্যে তারাই তাদের আত্মীয়, আত্মার পরিজন।
তো, এই উষ্ণতা বাড়ার পেছনে কারা দায়ী? চোখবুজে আপনারা লাদেনকে দোষারোপ করতে পারেন, সাথে তার প্রিয় বন্ধু জর্জ ডব্লিউ বুশকেও। দুজনই পৃথিবী জুড়ে এত বেশি বিস্ফোরণ আর যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে, উষ্ণতা বাড়বার ক্ষেত্রে এই দুই মাথামোটার অবদানও কিন্তু কম নয়!
যাকগে, সিরিয়াস কথায় আসি। আমাদের সৌভাগ্য এই যে এই একটা ক্ষেত্রে আমরা নন্দ ঘোষ বলে বিবেচিত হই নি বাকি বিশ্বের কাছে। আমাদের গরিবী এখানে আমাদের দায় অল্প হলেও কমিয়েছে। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়বার পেছনে সবচে বেশি কাজ করছে উন্নত বিশ্বের তাপ বা শক্তি উৎপাদনের উৎসগুলো। না, এই উৎসগুলো আলাদা কোন কাঠামো বা দালান কোঠা নয়, পুরো পরিবেশ, সমাজ বা দেশটাই এই উৎস হিসেবে কাজ করে। যেমন রাতের বেলা আলোর জন্যে জ্বালানো বাতি, অথবা গরমের দিনে চালানো এয়ার কুলার। সবসময় ব্যবহৃত হচ্ছে যেসব যন্ত্র সেগুলোও উষ্ণতার উৎস, যেমন রেফ্রিজারেটর, কম্পিউটার, টিভি, এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে বাহন- গাড়ি!
এই সবগুলো জিনিসই মানুষের জীবনের সাথে এমন তীব্রভাবে জড়িয়ে গেছে যে এগুলো হুট করে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাহলে গ্রীণ হাউজ এফেক্ট বন্ধের উপায় কি?
না, পুরোপুরি বন্ধের কোন কার্যকরী বা সুলভ উপায় পাওয়া যায় নি এখনো। তবে সেটা কমাবার কোন উপায় আছে কি না, এবং তাতে আমাদের মতন সাধারণ মানুষ কোনভাবে অংশগ্রহণ করতে পারতে কি না, এই চিন্তা থেকেই জন্ম নিয়েছে আর্থ আওয়ার-এর ধারণা।

শুরু করেছিলো সিডনীবাসীরা, আরেকটি সংগঠন WWF এর সাথে একাত্ম হয়ে। এ বছর, মানে ২০০৭ এর মার্চের শেষ দিনে সিডনী শহরের ২.২ মিলিয়ন মানুষ এবং প্রায় ২১০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাত সাড়ে সাতটা থেকে এক ঘন্টার জন্যে তাদের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিয়েছিলো। যারা ভাবছেন এতে আর এমন কি-ই বা হতে পারে, তাদের জন্যে তথ্যঃ ঐ এক ঘন্টা সময়ের ঐটুকু কাজের জন্যে সিডনির এনার্জি কনসাম্পশান তখন ১০.২% কমে গিয়েছিলো। এটা হচ্ছে প্রায় ৪৮,০০০ গাড়িকে রাস্তা থেকে এক ঘন্টার জন্যে সরিয়ে নেবার সমান! এই কাজে অংশগ্রহন করেছিলো সিডনীর প্রশাসনও, তাদের সহায়তায় আলো নিভিয়ে রেখেছিলো এমনকি হার্বার ব্রিজ এবং সিডনীর আরেক আইকন অপেরা হাউস।
সুন্দর একটা ভিডিও রয়েছে এ বিষয়ে, আর্থ আওয়ার-এর ওয়েব সাইটে।


এই বছর এই আর্থ আওয়ার ক্যাম্পেইনটি আরো বিস্তৃতি লাভ করেছে। বিশ্বের প্রায় ১২ টি বড় শহর ২০০৮ এর ২৯ মার্চ রাত আটটা থেকে এক ঘন্টার জন্যে তাদের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিবে। সিডনী, মেলবোর্ণ, ব্রিসবেন, শিকাগো, কোপেনহেগেন, টেল আভিভ, ম্যানিলা, টরোন্টো এবং আরো কিছু শহর রয়েছে এই তালিকায়।
বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ার মোট পরিমাণের তুলনায় এই এক ঘন্টার উদ্যোগ হয়তো নিতান্তই ছোট, কিন্তু বিন্দু বিন্দু পানি জমেইতো মহাসাগর হয়।
আমাদের দেশ ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছেয়, লোডশেডিং-এর কল্যাণে বেশিরভাগ সময়েই বাতি নিভিয়ে বসে থাকে। তবু যদি আলাদা করে বছরে একটি ঘন্টা প্রিয় পৃথিবীর জন্যে আর্থ আওয়ার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে, তবে আসলেই খুব ভালো হয়।
আমরা নিজেরাও ব্যক্তি উদ্যোগে এই ক্যাম্পেইনটিকে সফল করতে পারি। তালিকার বাইরের যে বড় শহরগুলোয় আমাদের বসবাস, সেখানে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারি। আর্থ আওয়ার ওয়েবসাইটটি এ ব্যপারে সাহায্য করছে।
আমাদের প্রতিবেশী বা বন্ধুদেরও জানাতে পারি এ কার্যক্রম সম্পর্কে। নানারকম পরিকল্পনা করা যেতে পারে ঐ এক ঘন্টার জন্যে, হয়তো বন্ধুরা সবাই মিলে নিজেদের ঘরের বাতি নিভিয়ে চলে যাওয়া যেতে পারে কোন মুভি শো-তে। ঐ এক ঘন্টা বাতিহীন কাটানো কোন সমস্যাই নয় আসলে।
ঠিক করেছি, ২০০৮ এর ২৯ মার্চ, শনিবার রাতে এক ঘন্টার জন্যে বাতি নিভিয়ে আমি আর আমার বউ মোমের আলোয় একটা ক্যান্ডল-লাইট ডিনার সেরে ফেলবো!
আমাদের এই ছোট্ট নীল-সবুজ পৃথিবীর জন্যে আপনি কি করবেন, সেটা এক্ষুণি ঠিক করে ফেলুন!

Popular posts from this blog

আরেকটিবার-

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান