পরবাসে তাবলীগের বশে

ইউনিভার্সিটি হলগুলোয় পরিচিত এক দৃশ্য ছিলো, আমাদের স্বাভাবিক বহুল তরংগায়িত জীবনে আরেক তরংগ আর কি। সেটা হলো, দুপুরের খাবারের পরে হয়তো সবাই চুপচাপ, বেডে শুয়ে আরাম করছে, কোথাও কোন রুমে হয়তো চলছে আড্ডা, এরকম অবস্থায় হুট করেই পুরো ফ্লোরে ফিসফাস করে ছড়িয়ে পড়লো খবর, "ঐ আইছে, আইছে রে, ভাগ সবাই!"
ব্যস, সবাই শোয়া বসা ছেড়ে হুড়মুড় করে গায়ে শার্ট চাপিয়ে পড়িমড়ি করে দে ছূট।
তা কে সেই সুধীজন, যার আগমনে এই পলায়ন নাটিকা?
না,ক্যাডার বা ঐ গোত্রীয় কেউ নন, তারা হলেন তাবলীগী জামাতের মানুষ।
লাঞ্চের পরপরই মূলত তারা 'হামলা' চালাতেন। মুখে অমায়িক হাসি, কথার শুরুতেই হাত মিলানোর জন্যে হাত চেপে ধরেন, এবং অলৌকিক ভাবে সেই হাত ছাড়ার কথা পুরোপুরি ভুলে যান। একদম মাগরিবের নামাজের পরে আজকের জমায়াতে হাজির থাকবো- এইরকম একটা অদৃশ্য সনদে সম্মতিসূচক দস্তখত না করা পর্যন্ত মুক্তি মিলে না।
তাবলীগি জামাতের পেছনের মূল কাহিনিটা আমার জানা নেই। তবে ধারণা করতে পারি, বিপথে যাওয়া মুমিনদের যায়-যায়-ঈমানকে পাকাপোক্ত করতেই তারা নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। আমার অবশ্য কোনই আপত্তি নেই তাতে। তবে বার তিনেক প্রায় একই ধরণের লম্বা লেকচারের মাঝে ঐ অমায়িক হাসিওয়ালা মানুষদের বিরক্ত করতে পারিনি বিধায় আমার টিউশানীর বাস ছুটে গেছিলো, তারপর থেকে আমিও সেই আতংকায়িত দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলাম। সেই অমায়িক হাসি দেখলেই আমার পিলে চমকে যেত, রাত বিরেতে দুয়েকটা দুঃস্বপ্ন দেখে ফেলেছিলাম কি না মনে পড়ছে না, তবে রুমের দরজায় লাগানো হ্যাঙারে একটা তৈরি শার্ট সবসময়েই ঝুলতো। যেন তাহাদের আগমনী বার্তা কানে এলেই নাগাল সীমার বাইরে চলে যেতে পারি।
মনে আছে, বন্ধু রানা এইরকম ক্রিটিকাল সময়ে একবার শেষমুহুর্তে ওদের হাতে পাকড়াও হয়ে গিয়েছিলো। ওর উপস্থিত বুদ্ধি খুব ভাল, মুহুর্তেই মুখ করুণ করে বলেছিল, "আমি ভাই জগন্নাথ হলে থাকি,এমনিই এসেছিলাম এখানে!'
ব্যস, ইতিহাসে সম্ভবত ওর হাতই সবচে দ্রুত সেই নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়েছিলো!
--------------

ক'দিন আগে বিকেলে, কাজ নেই তাই বাসায় বসে আছি আরাম করে। দরজায় ঠকঠক। বউ উঠে গেলো দরজা খুলতে। গিয়েই সাথে সাথে ফিরে এলো। "তুই যা।" আমি চোখে মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি মাথায় টুপি, লম্বা পাঞ্জাবী পরনে, শ্মশ্রুমন্ডিত দুইজন মানুষ। ঢাকা থেকে মেলবোর্ণ আসতে আসতে পরিবেশ আবহাওয়া আর মানুষের ধরণ ধারণ সবই বদলে গেছে, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেই অমায়িক হাসি বদলায় নি। এতদিন বাদে সেই চিরচেনা হাসির ধরণ দেখেই চিনলাম, যদিও ঠিকঠাক বিশ্বাস হচ্ছিলো না আমার, এখানেও?!?
আমি তখন আমার সবচেয়ে প্রিয় পোশাক পরা, হাফপ্যান্ট আর টি-শার্ট। খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা আমার। দু'জনের মধ্যে একজনই কথা বললেন সব। কথা না বলে প্রশ্নবান চালালেন বলা চলে। বাংলায়। কি করি, পড়ি না পি আর, বাড়ি কই, কোথায় পড়েছি, স্কুল কলেজ, এখানে কোথায়, কি জব করি...। সর্বশেষ ভিসা ফরম বাদে নিজের সম্পর্কে এওসব ব্যাক্তিগত প্রশ্নের উত্তর আর কোথায় দিয়েছি আমার মনে পড়ে না!
ভদ্রলোক এখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। এটুকু শুনে বসতে বললাম ভেতরে। হাজার হোক, শিক্ষক মানুষ। আমাকে জানালেন তিনি বুয়েটে পড়েছেন, শিক্ষকতাও করেছেন সেখানে বেশ কয়েক বছর।
ঘরে ঢুকতেই টিভি-র সাথে লাগানো এক্সবক্স গেইম স্টেশান দেখে উনি বোধহয় আন্তরিক হতে চাইলেন একটু, জিজ্ঞেস করলেন, 'কার এটা, আপনার বাচ্চার?'
আমি বিষম খেলাম। ভূঁড়িটা বেড়েছে ইদানীং জানি, এবং খানিকটা গাট্টাগোট্টাও হয়ে গেছি, কিন্তু তাই বলে বাচ্চার বাপ!
হাসিমুখে জানালাম, না, ওটা আমারই। বাচ্চা কাচ্চা এখনো নেই।
তারপরে লম্বা আলাপ হলো। প্রায় বছর পাঁচেক আগে শোনা কথাগুলোর সাথে কোন তফাত নেই। পার্থক্য এই যে এইবারে টিউশানী ধরার তাড়া ছিলো না, তাই মুখে হাসি ধরে রেখে সব শুনলাম। তবে এখন আমিও অনেক বদলে গেছি, হাসিমুখে 'না' বলে দিতে পারি। স্পষ্ট করেই জানালাম যে আমি নিজের মত করেই ধর্মকর্ম করি, এবং এইরকম মজলিশে যাবার ব্যাপারে উৎসাহী নই।
আগের বারের গুলোর তুলনায় ইনি আসলেই নিতান্তই ভদ্রলোক। খানিক চেষ্টার পরে বুঝলেন, হবে না, তাই জোরও করলেন না আর। পাশের মানুষটা এতক্ষণ কোন কথা বলে নি, প্রতি কথায়ই শুধু হেসে হেসে মাথা নাড়ছিলো, তাই এতক্ষণ বুঝিই নি উনি বাংগালী নন। যাবার আগ মুহুর্তে ইংরেজীতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আশপাশে পরিচিত কোন মুসলিম ব্রাদার আছে কি না?
তা আছেন বেশ ক'জন। তবে ঠিক কোনজনের বিকেলের আরাম মাটি করবো সেই সিদ্ধান্ত নিতে খানিকটা দেরি হলো, অবশেষে একজনের বাড়ির হদিশ দিয়ে বিদায় জানালাম।
বুঝতে পারছি না, এই অমায়িক হাসি কি এখন থেকে নিয়মিতই দেখতে হবে কি না!

Popular posts from this blog

আরেকটিবার-

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান