আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের "প্রেমের গপ্পো"

ইলিয়াস আমাদের কাছে খুব বেশি মালমশলা রেখে যান নাই, মাত্র ২৮ টা গল্প, অল্প কিছু প্রবন্ধ আর ২ টি উপন্যাস, সাকুল্যে এই আমাদের সম্পদ। কিন্তু অল্প সংখ্যক লেখা দিয়াই তিনি নিজের স্টাইল দাঁড় করে ফেলেছেন। যে কারণে ইলিয়াসের লেখা পড়েই আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা কার লেখা।
তো কি সেই স্টাইল?
আমি জেনারালাইজড করতে পারছি না। তবে নিজের পাঠানুভুতি বলতে পারি।
ইলিয়াসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ লাগে বর্ণনা। আমি নিজে বর্ণনার খুব ভক্ত। গল্প যখন মাথার ভেতর সিনেমা হয়ে ওঠে, সেই মুহুর্তেই আমার গল্পরে ভালবাসতে ইচ্ছা করে। তার আগ পর্যন্ত দুরে ঠেলে বসিয়ে রাখি। ইলিয়াসের গল্পগুলান এই দিক দিয়ে একদম যা-তা রকমের ভাল। বর্ণনাগুলা এত সাবলীল যে মাত্র অল্প কিছু লাইনের পরেই মাথার ভেতরে গল্পের দৃশ্যগুলার চিত্রায়ন করে নিতে কোনরূপ সমস্যা হয় না। তারপরে ক্রমশ সেটা ফেনায়িত হতে থাকে, গরম কফির মত। তখন খানিকটা নেশাও লেগে যায়, বর্ণনার গুণেই।
ইলিয়াস পড়তে গিয়া আমি যে সমস্যায় পড়েছি, সেটা সাধারণত অমনোযোগী/ নতুন পাঠকদের বেলায় ঘটে। কিন্তু আমি মনোযোগী পাঠক, তবু এই সমস্যার কারণ ধরতে পারি নাই বলে দোষটা ইলিয়াসের গদ্যের উপরই চাপিয়ে দিতে দ্বিধা করি নাই। সমস্যাটা হলো- বর্ণনার এই অস্বাভাবিক গুণের কারণেই মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলতে হয়। দৃশ্য বা দৃশ্যচিত্রে এমন করে ডুবে যেতে হয় যে, গল্প থেকে সরে যাই মাঝে মাঝে, ছবিটাই মাথা জুড়ে আসন গাড়ে। তখন খানিকটা গা ঝাড়া দিয়ে মনে করে নিতে হয়- গল্পটা আসলে এই ছিলো!
*

প্রেমের গপ্পো- আমি বলবো- ইলিয়াসের অন্যগুলার চেয়ে একটু আলাদা।
ভাষা একদম সহজ সরল, ইলিয়াসের অন্যগুলোর তুলনায়। ইলিয়াস যেটা করেন, চরিত্রগুলার চিন্তা-চেতনারে সাথে নিয়ে গল্প এগুতে থাকেন। অনেকে এই ক্ষেত্রে স্বগতোক্তি ব্যবহার করেন, কিন্তু ইলিয়াস সেইটার ধার ধারেন না। উনি নিজেই চরিত্রের মনের কথা, অলমোষ্ট, চরিত্রের ভাষায়ই গল্পে তুইলা আনেন।
সংলাপ গুলায় কোন অবাস্তবতা নাই। নতুন বিয়ার পরে স্বামী-স্ত্রী যেভাবে আলাপ করে, ঠিক সেই সুরে পুরা গল্পের সংলাপ আর বয়ান এগিয়ে যায়, কোন ছন্দপতন ছাড়াই।
একটা সংলাপ যেমন, " আমার থ্রো দেখে বলে, আপনার হাতের মুভমেন্ট খুব ম্যাজেস্টিক, আবার খুব ফাস্ট।"- এইখানে আমরা হয়তো ইংরেজি শবদগুলারে ঠিক এইভাবে লিখতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম, কিন্তু তাহলে যেটা হইতো, এইটা ঠিক রিয়েল হয়ে উঠতো না। আবার যদি শুধু সংলাপে এইরকম সাবলীলতা রাইখা বর্ণনায় বিশুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করতেন, তাহলে হয়তো বাংলা গল্প লেখার নিয়ম মানা হইতো, শুদ্ধ গল্প লেখা হইতো, কিন্তু আবারো সেইটা রিয়েলিটি থেকে সরে যেত।
যেমন এইখানে-
বুলা ফের হাসে, 'আবার ঢাকাইয়া ল্যাংগুয়েজ।'
কিন্তু জাহাংগীরের তখন ফ্লো এসে গেছে। ' এক্কেরে লাইন। বনানী, গুলশান...'
এই যে বর্ণনাতেও গল্পের চরিত্রগুলার মতনই কথা ব্যবহার করা, এইটাই আমার কাছে ভাল লাগলো। ইলিয়াসের অন্য গল্পগুলার মতন, এই গল্পটাও পড়ার পর মনে হইলো, যেন একটা সংগীতসন্ধ্যার শুরুতে কোন একজন ওস্তাদ তার যন্ত্রপাতি গুলা টিউন করে রাখছেন, তারপর সেই সুরেই পুরো বাজনা বাজাইলেন। কোথাও সুর কাটে নাই।
*

এই গল্প নিয়া আলাপ করতে গিয়ে (আনোয়ার সাদাত) শিমুল একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, হাসপাতাল ও তার পরবর্তী বিশ্লেষণের স্পষ্টতা কী?
আমি মনে করি, সুনীলদাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলা আসলে জাহাংগীরের চরিত্র নির্মাণের জন্যেই দরকার ছিলো।
জাহাংগীর আসলে কেমন মানুষ। আপাতত সৎ, এবং একটু সহজ সরল মানুষ। জীবনের খুব বেশি উন্নতি করতে পারে নাই, এখনো স্ট্রাগলিং। এই ধরণের মানুষগুলা খুব বেশি কল্পনা বিলাসে ভোগে আসলে। তারা বাস্তবে যা পারে নাই, কল্পনায় সেটা অধিকার বা দখল করার চেষ্টা করে। এ কারণেই, চাকরিতে সমস্যার পরেও জাহাংগীরের এটা ভেবে নিতে ভাল লাগে, অফিসে সবাই তারে খুব সম্মান করে। কলেজ জীবনে কোন মেয়ের সাথে কখনোই কথা বলে নাই। এই অতৃপ্তিটা পোষানোর জন্যে তার কাছে আসলে কল্পনার আশ্রয় নেয়া ছাড়া কোন গতি থাকে না। সে তাই কোন এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা মাত্র এক লাইন শুনেই শাহীন বা শাহনাজের পুরো চরিত্র দাঁড় করে ফেলে। যেখানে সে নিজেই হিরো। কল্পনা বিলাসী মানুষ এই রকম কল্পনাগুলা নিজে খুব বিশ্বাস করে, এবং এই বিশ্বাসটাকে ভিত্তি দেবার জন্যে যাদের সাথে ঐ ঘটনার কোন যোগ নাই, তাদের কাছে সত্যের মত করেই গল্প করে। হিপ হিপ হুররে-র প্রসঙ্গে তার ভাবনা-চিন্তাগুলো এরকম হবার কারণও এই।
সুনীলদার হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন মুশতাক আর বুলা কান্না করে, তখন জাহাংগীরের একটা ঈর্ষা হয়, সে টের পায়, ও ঠিক বুলা-মুশতাকের লেভেলের মানুষ না। বুলা-মুশতাক কোন লেভেলের? যে লেভেলে যাবার কল্পনা সে করে। কিন্তু বাস্তবে পারে নাই।
এই কারণেই বুলা-মুশতাক যখন একসাথে কান্নাকাটি করে, তখন জাহাংগীর নিজের ভেতরে টের পায়, কারো সাথে আসলে স্মৃতি নিয়া তার কোন ভাগাভাগি নাই। কল্পনায় সে নিজেই নিজের নায়ক, ঐখানে নানা মেয়ে তাকে প্রস্তাব দেয়, ওইখানে সে হিরোর মতন সবাইকে রক্ষা করে, কিন্তু বাস্তবে সে আসলে বড় একা। এই সুখকল্পনাগুলা একান্তই তার নিজের, একার।
একজন আধা-সফল ( প্রকারন্তরে আধা-ব্যার্থ ) মানুষের চরিত্রের একটা পার্ফেক্ট ছবি হলো এই জাহাংগীর।
*

ইলিয়াসের এই গল্পটা তাই আমার খুব প্রিয় গল্প। পড়ার পরেই আমার মনে হয়েছিলো, আরেসশালা! কেউ কইবো এইটা ইলিয়াসের গল্প?
কিন্তু, তারপরেই মনে হইছে, এই কারুকার্যময় গল্পটা পড়ার পরে যে কেউই বুঝে যাবে- এই গল্প কেবল ইলিয়াসেরই!

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-