সিজন্স অব বিট্রেয়াল | দময়ন্তী
সাতচল্লিশ সালের দেশভাগ নিয়ে লেখাপত্র আমি আদতে এড়িয়ে চলি। যা কিছু পড়েছি, নন-ফিকশান অথবা গল্প-উপন্যাসে, কোনো অভিজ্ঞতাই স্বস্তিকর হয়নি আমার জন্যে। পড়তে চাই, কিন্তু পেয়েও পড়িনি, এরকম টেক্সটের সংখ্যাও কম নয়। হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি শুরু করেই থামিয়ে দিয়েছিলাম, আজও শেষ করা হয়নি। মাহমুদুল হকের লেখায় অবশ্য দেশভাগ এসেছে, তবে তিনি তার ওপরে একটা মায়ার পর্দার আড়াল টেনে লিখে গেছেন, তাই সেসব পড়ে ফেলতে পেরেছি শেষমেশ। কিন্তু সেগুলোও আমার মনোজগতে বিশাল ঝামেলা করে রেখে গেছে।
এসবই একান্তই আমার ব্যক্তিগত অপারগতা অবশ্য, ঢোল পিটিয়ে বলার মত কিছু নয়।
আমি আজ অব্দি এই দেশভাগের ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝে উঠতে পারিনি। লক্ষ কোটি মানুষ একরাতের ব্যবধানে হঠাৎ করে ঘরছাড়া হয়ে গেছে, দেশহীন হয়ে গেছে; শুধু ভিন্ন ধর্মের বলে জন্মাবধি প্রতিবেশী তার সব কিছু ছিনিয়ে নিতে উদগ্রীব; চেনা হোক কি অচেনা, প্রাণে মেরে ফেলতে একটুও দ্বিধা হচ্ছে না শুধুমাত্র ভিন্ন নামের বলে…। আমি কিছুতেই মানুষের এই তীব্র কদর্য চেহারা মেনে নিতে পারি না।
দময়ন্তী-র লেখা “সিজনস অব বিট্রেয়াল” অনেক আগে হাতে এলেও, এতদিন সেটা পড়া হয়ে উঠছিল না এ কারণেই। সম্প্রতি এ বিষয়ক আরও কিছু লেখাপত্র পড়তে হয়েছে নানান কাজে, সেগুলো পড়ার ফাঁকেই সিদ্ধান্ত নিলাম এ বইটাও পড়ে ফেলতে হবে। মাত্রই ঘন্টাখানেক আগে সেই পড়া শেষ হলো।
এক কথায় বলতে গেলে, সেই সময়কে বর্ণনা করার জন্যে “বিশ্বাসঘাতক” -এর চেয়ে সঠিক শব্দ আর একটাও নেই। দময়ন্তী-র লেখার হাত খুব শক্তিশালী। বইয়ের বিষয়বস্তুর নিজস্ব ভার আছে, আর এই বইটি লেখা নিজের পরিবারের স্মৃতিকথা থেকে, তার মানে আবেগ নিয়েও কাজ করতে হয়েছে অনেক লিখতে গিয়ে। তবু যে এমন নির্ভার বর্ণনা বইয়ের, একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, এটা খুব সহজ কাজ নয়।
উপন্যাস নয় এই বই, ইতিহাসই বেশি। তবু কেমন ছবির মত বর্ণনা একেবারে। সবাইকে কেমন সিনেমার মত দেখতে পাচ্ছিলাম পড়তে পড়তে। যে পরিচ্ছেদে যেমন দরকার, বর্ণনার ভাষায় সেরকম পরিবর্তনটা ভালো হয়েছে। জামু চরিত্রটির পরিচ্ছেদগুলোয় হিন্দি/উর্দু মেশানো ন্যারেশান এর প্রশংসা না করে পারা যায় না আসলে।
বই হাতে নেয়ার আগেই মনে মনে প্রস্তুতি নেয়া ছিল, তবু কিছু কিছু অংশে মানুষের বর্বরতার বিবরণ পড়তে গিয়ে থমকে যেতে হয়েছে। বইয়ের পাতায় পড়ি, তবু মনে প্রশ্ন আসে, মানুষকে কেমন করে বিশ্বাস করে মানুষ?
ইতিহাস, কল্পনা, গল্প, দুঃখ, আনন্দ, আর বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা, খুবই নির্মোহ আর পারদর্শী কলমে লেখা হয়েছে সব কিছু।
একটানা পড়ে যাওয়ায় হঠাৎই বইটা শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হলো আমার কাছে। যোগেশ, লাবণ্য, যুঁই এর গল্প জানা বাকি রয়ে গেলো। তবে এটা সিজন-১, তাই দেখে মনে মনে আশ্বস্ত হলাম, পরের বইয়ের অপেক্ষায় থাকবো অবশ্যই।