যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইবো কত আর-

সূচীপত্রের সিঁড়ি বেয়ে আমি টপাটপ নামতে থাকি, আটাশে গিয়ে থামবার কথা, কিন্তু তেইশ পর্যন্ত গিয়েই থেমে যেতে হলো! মাওলা ব্রাদার্স থেকে বের হওয়া গাট্টাগোট্টা আকৃতির বই, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনাসমগ্র প্রথম খন্ড। বইয়ের শেষের ফ্ল্যাপে প্রকাশক বলে দিয়েছেন ইলিয়াসের আটাশটা গল্প নিয়ে এই সমগ্র, এমনকি ভুমিকায় লেখকের ছোট ভাই খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের বক্তব্যও তাই, গল্প আছে এখানে আটাশটি। কিন্তু আসলে তা নেই! এক দুই তিন চার করে বেশ কবার আঙুল বুলিয়ে গুনে গুনে গেলাম, উচ্চারণ করে করে পড়তে গিয়ে দুয়েকবার কবিতা বলে ভ্রম হলো, কিন্তু কিছুতেই তেইশের ওপরে যেতে পারলাম না! পাঁচটি গল্প তাহলে কোথায় গেলো, নেই?

আমার নিজেকে খানিকটা প্রতারিত মনে হলো। আটাশ সংখ্যাটা বেশ করে মাথায় গেঁথে গেছে। আমি কোথাও ভুল হচ্ছে ভেবে আবারও গুনতে থাকি।
ফেইসবুকে কে একজন টোকা দিয়ে জানালো, মাযহার ভাইয়ের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি গোনা থামাই। কলেজের গ্রুপ-ইমেইলে আরেকজন বললো, হায়দার ভাইও নাকি নিখোঁজ। আমি আবারও গুনি, একুশ বাইশ তেইশ।

মাযহার ভাই আমাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র। দুই তিন। আর হায়দার ভাই তিন ব্যাচ। মাযহার ভাই ভাল এথলিট ছিলেন। মাযহার ভাই দ্রুত দৌড়াতেন, একশ মিটার দৌড়ে কি ওনার রেকর্ড ছিলো কলেজে? মনে নেই। একশ দুশ চারশ মিটারের দৌড় হতো। আমি আবার গুনি প্রথম থেকে। প্রথম বইয়ের প্রথম গল্প, নিরুদ্দেশ যাত্রা। তারপরে উৎসব, প্রতিশোধ। নেমে যাই আবার। আট নয় দশ। মাযহার ভাইকে শেষ কবে দেখেছি, দশ বছর আগে? না না, পাঁচ বা ছয় হবে, শেষ রিইউনিয়নেই তো দেখলাম। ফেইসবুকে নাফিজ ভাই বললো, মাযহার সকালে এসএমএস করেছিলো পিলখানা থেকে, তারপরে খবর নেই। সকাল কয়টায়? সকাল এগারোটায়। এগারো, এগারো নম্বর গল্পের নাম মিলির হাতে স্টেন গান। আমার অসম্ভবর প্রিয় গল্প। মাযহার ভাইয়ের বিয়ের ছবি খুলে বসলাম ফেইসবুকে, মাত্র দুমাস আগেই বিয়ে হলো ওনার। হয়েছিলো দরবার হলে। নাফিজ ভাই বললো, এখন নাকি দরবার হলেই আছেন উনি। তবে যোগাযোগ হচ্ছে না।

কিন্তু বাকি পাঁচটা গল্প কোথায়? বই ধরে ধরে এগুবো নাকি? ইমেইলে অবশ্য হায়দার ভাইয়ের খোঁজ শুরু হলো তখন। হায়দার ভাই আমার টেবলেই বসতেন ডাইনিং এ। না, আমার না, হয়তো পাশের টেবিলে। হায়দার ভাই অসম্ভব সুদর্শন ছিলেন। হায়দার ভাই আমাদের কলেজের বারোতম ব্যাচের। বারো নম্বর, আমরা পনের। আচ্ছা বারো নম্বর গল্পের নাম কী? হুম, দুধভাতে উৎপাত। মনে হচ্ছে বই ধরে ধরে এগুলেই পাওয়া যাবে।
পাওয়া যায়নি, জানালেন আরেকজন, ইমেইলে, হায়দার ভাই বা মাযহার ভাই কারও খোঁজই পাওয়া যায়নি। হায়দার ভাই যখন বাস্কেটবল খেলতেন, আমার কাছে মনে হত জুয়েল আইচ যেন যাদু দেখাচ্ছেন, অসম্ভব স্টাইলিশ। থ্রি স্কোর একদম অহরহ, যেন দুধভাত।

পত্রিকায় ছবি এসেছে অনেক, দেখছি। এনটিভির নিউজ, এটিএন বাংলায় মুন্নী সাহা দৌঁড়ুচ্ছে ঐ। কিন্তু পাঁচটা গল্প হাপিশ।

বইয়ের প্রথম সংস্করণ এসেছে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯। সর্বশেষ সংস্করণ এপ্রিল ২০০৩। এই দশ বছরে কেউ টের পেল না যে জলজ্যান্ত ৫ টা গল্পের কোন খোঁজ নেই? না কেউ টের পায়নি। মুনওয়ার ভাই জিগ্গেস করছেন, ডিবি টের পেল না কেন? বা ডিজিএফআই? ওরা কী করেছে বসে বসে? এত বড় একটা ম্যাসাকার ঘটে গেলো!

আমার রোখ চেপে গেলো, পাঁচটা গল্প যদি না পাই? অথবা মাযহার ভাই বা হায়দার ভাই।

মুহাম্মদ সিসিবিতে একটা তালিকা ঝুলিয়ে দিলো। আমি তালিকা দেখি, বইয়ের শেষেও একটা তালিকামতন আছে। ওখানে সবগুলো গল্প বইয়ের নাম দেয়া সূচী সহ। তালিকার মাঝামাঝি গিয়ে মাযহার ভাইকে পাওয়া গেলো। উনি আর নেই। আমি গুনতে শুরু করলাম গল্পের নাম গুলো, সূচীতে না, বইয়ের নাম দিয়ে।

ইমেইলে কে যেন আবার মাযহার ভাইয়ের ছবি দিলো একটা, ওনার এক পাশের চোখ নেই। আমার গলা ধরে এলো ক্রমশ। হায়দার ভাইয়ের ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে শুনলাম। কিন্তু শুনলাম হায়দার ভাইও আর নেই। মুহাম্মদের তালিকায় কনফার্ম হলো সামিয়ার আব্বুর নামও। আমি ঝাপসা চোখে পুরো তালিকা গুনে শেষ করলাম, বইয়ের নাম ধরে ধরে।

গল্প আসলে তেইশটাই, বইয়ের সংখ্যা যদি ঠিক থাকে। সুতরাং পাঁচটা গল্পের হয়ত অস্তিত্বই নেই আসলে, অথবা আছে হয়ত, হারিয়ে গেছে।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-