পারাপার | শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
এই একটা বইয়েরই তিনটা কপি রয়েছে আমার কাছে।
প্রথমটা বহু বছর আগে ছোটমামার দেয়া উপহার। নিজে দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে মামা কিনে দিয়েছিল। তার দু’বছর বাদে আমি দেশ ছাড়ি যখন, তখন আরও দু’টি বাংলা বইয়ের সাথে এটি ছিল আমার সঙ্গী। মামা নেই, তবে এই বইয়ের প্রচ্ছদ ওল্টালে দ্বিতীয় পাতায় মামার হাতের লেখা এখনও আছে।
‘পারাপার’ আমার খুব প্রিয় বই। এই বুড়ো বয়সে এসে সবচেয়ে প্রিয় বইয়ের তালিকা এখন আর খুব ছোট নেই। অনেকগুলো বইয়ের নাম সেখানে গাদাগাদি করে আছে। ওয়ানডে ক্রিকেটের বেস্ট অলরাউন্ডারের তালিকার মত সেখানে বইয়ের নামের বদল হয় নিয়মিতই। তবে, সবচেয়ে প্রিয় বই বলে একটা কিছু যে হতে পারে, এই ধারণা আমার ভেতরে প্রথম এসেছিল ‘পারাপার’ পড়ার পরে।
এই বইয়ের সবাই; ললিত, সঞ্জয়, তুলসী, রমেন- এরা প্রত্যেকে যেন আমিই। ললিতের মতই ‘নিজের মন না বোঝা’ কোনো এক শাশ্বতীর দিকে তাকিয়ে যেন জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি আমিও। আমি যেন তুলসীর মত ভীতু কেউ, হঠাৎ আয়নায় আগন্তুক দেখে চমকে যায় যে। অথবা আমি যেন সঞ্জয়, সুযোগসন্ধানী কোনো বেনিয়া, তবে বন্ধু-অন্তপ্রাণ। অথবা রমেন, রেলে কাটা মানুষকে যে বুকে টেনে বসে থাকে, পিয়ানো বাজিয়ে যে গায় পূব বাংলার মাঝিদের গান।
বহুবার পড়ায় এই বইটা জীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল দেখে, আরেকটা কপি কিনতে চাইলাম, প্রথম কপির ব্যবহার যেন থামিয়ে দিতে পারি। দ্বিতীয় পাতার বলপেনের লেখাটা যেন বিলীন না হয়ে যায়।
শুনে পরের কপিটা কিনে দেশ থেকে পাঠিয়েছিল বড় আপু। আর তৃতীয় কপিটা কিনে দিয়েছিল তিথি, ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আনন্দ একটা কপি বের করেছিল, এ দেশের ভাষায় যাকে বলে ‘লার্জ প্রিন্ট’, অনেকটা সেরকম।
আজ ২ নভেম্বর, এই উপন্যাসের লেখক শীর্ষেন্দুর জন্মদিন। মানুষ বেঁচে থাকলে নাকি বদলায়। লেখকেরাও মানুষ, বদল তাই অবশ্যম্ভাবী। তবু, আজ সেই পুরনো পারাপারের লেখক শীর্ষেন্দুকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। যে পারাপারের ছাপা অক্ষরগুলোয় আমার অনেকগুলো অস্তিত্বের গল্প লেখা।