মাসুদ রানা-র কপিরাইট এবং চুক্তিপত্রের গুরুত্ব
খবরে দেখলাম, প্রয়াত লেখক শেখ আব্দুল হাকিম-কে মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের স্বত্বাধিকারী বলে ঘোষণা করেছে দেশের কপিরাইট কর্তৃপক্ষ।
মাসুদ রানা, কাজী আনোয়ার হোসেন এবং শেখ আব্দুল হাকিম, এই সবগুলো নামই বাংলাদেশী পাঠকদের আবেগের সাথে এমনভাবে জড়িত যে, এই মামলা, অভিযোগ এবং তা থেকে আসা সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক রকমের মতামত দেখা যাচ্ছে। কেউ বলছেন শেখ আব্দুল হাকিম-ই বইগুলোর ন্যায্য দাবীদার, আবার কেউ বলছেন কাজী আনোয়ার হোসেন এগুলোর প্রকৃত স্বত্বাধিকারী।
স্বল্পজ্ঞানে যতটুকু বুঝি, কপিরাইট কর্তৃপক্ষের ঘোষণায় কোনও ভুল নেই; আইন অনুযায়ী এগুলোর স্বত্বাধিকারী শেখ আব্দুল হাকিম। আবার একই সাথে আমি মনে করি, এই বইগুলোর স্বত্ব আসলে কাজী আনোয়ার হোসেনের হওয়া উচিত, হাকিমের নয়।
কেন?
সহজ কথায়, যে কোনও সৃজনশীল কাজের কপিরাইট নিজে থেকেই তার স্রষ্টার কাছে থাকে। মানে, কেউ যদি একটা গান তৈরি করে, অথবা নিজের লেখা কোনও বই প্রকাশ করে, তাহলে সেটির কপিরাইট হবে সেই সঙ্গীতশিল্পী কিংবা লেখকের। এই স্বত্ব দাবী করার জন্যে আলাদা করে কোথাও নিবন্ধন করার দরকার পড়ে না। বইয়ে অথবা এলবামের কোথাও কোনও ঘোষণার দরকার হয় না, কোনও © চিহ্ন ব্যবহারেরও প্রয়োজন হয় না।
এরকম ঘোষণা বা প্রমাণপত্রের দরকার তখনই পড়ে যখন কেউ তাঁর কাজের স্বত্ব অন্য কাউকে দিয়ে দেন। সেটা অর্থের বিনিময়ে হতে পারে, বা অন্য যে কোনও কারণে।
মাসুদ রানা-র ক্ষেত্রে আমরা জানি শেখ আব্দুল হাকিম ছায়ালেখক (গোস্টরাইটার) হিসেবে সেবা প্রকাশনী বা কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষে এই বইগুলো লিখেছিলেন।
গোস্টরাইটিং বিশ্বজুড়েই একটি বহুল প্রচলিত ব্যবস্থা। বহু প্রকাশনী এবং লেখক প্রতিনিয়ত ছায়ালেখকদের সাথে কাজ করেন। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, ছায়ালেখকদেরকে কাজের শুরুতে চুক্তিবদ্ধ হতে হয় এই মর্মে যে, এই বই লেখার বিনিময়ে তারা পারিশ্রমিক পাবেন তবে বইটির স্বত্ব তারা দাবী করতে পারবেন না। বইয়ের স্বত্বাধিকারী থাকবে প্রকাশনী বা সেই লেখক, যার হয়ে ছায়ালেখক বইটি লিখছেন।
এই সূত্র মেনে বলা যায়, এই বইগুলোর আসল স্বত্বাধিকারী কাজী আনোয়ার হোসেন। তিনি শেখ আব্দুল হাকিমকে তাঁর যথার্থ সম্মানী দিয়েছিলেন কিনা সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, কপিরাইটের সাথে সম্পর্কিত নয়।
তাহলে এখানে সমস্যা কোথায়?
খবর থেকে যতটুকু বুঝলাম, সমস্যা হচ্ছে চুক্তিপত্রের অনুপস্থিতি।
সেবা প্রকাশনী থেকে দাবি করা হচ্ছে কাজী আনোয়ার হোসেন এবং শেখ আব্দুল হাকিমের মধ্যে মৌখিক চুক্তি হয়েছিল। এই কথাটি অবিশ্বাস করার কোনও কারণ দেখি না, কারণ ১৯৬৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শেখ আব্দুল হাকিম সেবা-র হয়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লিখে গেছেন। কিন্তু মৌখিক চুক্তি কপিরাইট আইনে কাজে লাগে না। ওই বইগুলোর প্রকৃত লেখক যে শেখ আব্দুল হাকিম, সেটা সেবা প্রকাশনীও অস্বীকার করছে না। এবং যেহেতু কাগজপত্রে তিনি স্বত্ব সেবা-কে দেননি, তাই কপিরাইট আইন বলছে এগুলো তাঁরই বই, সেবা-র নয়।
সুতরাং, শেখ আব্দুল হাকিমের পক্ষে এই বইগুলোর স্বত্ব দাবী আসলে বেআইনি নয়। আবার এ কথা সত্যি হলেও আইনের ফাঁক ব্যবহার করে তাঁর এই দাবীর ন্যায্যতা এবং নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।
অবশ্য আইন এবং মূল্যবোধের বিরোধ আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়, যুগ যুগ ধরে এটা চলে আসছে।
এই ঘটনা আর কতদূর গড়াবে এখনও বুঝতে পারছি না। তবে আমি প্রাসঙ্গিক আরেকটি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের দেশের লেখক এবং ছায়ালেখকদের কাছে অনুরোধ থাকবে, তাঁরা যেন বই প্রকাশের আগেই তাঁদের প্রকাশকদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, চুক্তির প্রসঙ্গ হাজির হলেই দেশের লেখক-প্রকাশক দুই পক্ষই একটা অস্বস্তিতে ভোগেন, ভাসুরের নাম মুখে না নেয়ার মত অদ্ভুত আচরণ শুরু করেন। দয়া করে এই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসুন। আপনি লেখক হলে অকুণ্ঠচিত্তে প্রকাশকের কাছে চুক্তিনামা চান। আপনি প্রকাশক হলে একটা সাধারণ চুক্তিনামার নমুনা তৈরি রাখুন; মনে রাখবেন এটা আপনার পেশাদারিত্বের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে।
ভবিষ্যতের অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা এড়াতে সঠিকভাবে দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের সংস্কৃতি আমাদের প্রকাশনা জগতে অবিলম্বে চালু হবে, এমনটাই আশা করি।