শাম্মী



২০০৪ সালের কোন এক বিকেল। হঠাৎ সিদ্ধান্তে একটা জরুরি কাজে আমাকে যেতে হবে দিল্লী। ‘বহু দূর’- অর্থে দিল্লী না, সত্যি সত্যি নয়া দিল্লী। দিন সাতেকের কাজ। এই প্রথম দেশের বাইরে যাওয়া হচ্ছে আমার। বন্ধুদের সবাই প্রায় পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত, একেবারে একা যেতে হবে এই নিয়ে একটু ভাবনায় ছিলাম। শাম্মী-কে জিজ্ঞেস করলাম, যাবি নাকি আমার সাথে? শাম্মী খুব বেশি সময় নিলো না, কয়েক মুহুর্ত চিন্তা করে বললো, যাবে। কিন্তু ওর ভিসা করানো নেই, পাসপোর্টও মাইমানসিং-এ, আর আমার যাবার পরিকল্পনা আগামীকাল। আমি বললাম, নিয়ে আয় পাসপোর্ট। 
শাম্মী দৌড়ালো মাইমানসিং। পরদিন সকালে সেই পাসপোর্ট নিয়ে সোজা ইন্ডিয়ান এমব্যাসিতে। একবারে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে গেছে। আমি বলেছি, ভিসা পেলে সোজা বাস স্টপে চলে আসবি, আর না পেলে হলে চলে যাবি। 
 দুপুর পর্যন্ত ভিসা-র কোন খবর নেই। আমি ঢাকা-কোলকাতা বাসে দুইজনের জন্যে দু’টা টিকেট কেটে নিয়ে বসে আছি। এর মাঝে ওর মোবাইলের ব্যাটারি গেছে মরে। খোঁজ নেয়ার উপায়ও বন্ধ। একটু পর পর ঘড়ি দেখছি, সময় বেশি বাকি নেই। বাস ছাড়ি ছাড়ি করছে। 
শেষ মুহুর্তে পড়ি মরি করে শাম্মী দৌড়ে ঢুকলো বাসে, মুখে সেই চিরপরিচিত সব দাঁত বের করা হাসি। ভিসা পেয়েছে! 
আমাদের যাত্রা শুরু হলো। ভারত যাত্রা। 
আমি আমার কাজের চিন্তায় খুব বেশি কিছু ভাবতে পারছি না, কিন্তু শাম্মী সবসময়ের মতই বিন্দাস, মাথায় একটা ক্যাপ চাপিয়ে আরাম করে ঘুরে বেড়াচ্ছে! 
কোলকাতায় আমাদের প্রথম স্টপেজ। সেখানে দুদিন থেকে পরের গন্তব্য দিল্লী। 
কোলকাতা থেকে দিল্লীর ট্রেনে উঠে হতভম্ভ হয়ে গেলাম। বাদ বাকি যাত্রীরা সবাই দেখি বিছানা-বালিশ-লেপ নিয়ে এসেছে। কেন তা কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না, রাত হতেই বুঝে গেলাম কারণ। ভয়ংকর ঠাণ্ডা পুরো ট্রেনে, জানালা লাগিয়েও মানানো যাচ্ছে না। ট্রেন ছুটছে, সেই সাথে কোন একটা ফুটোফাটা দিয়ে হুহু করে বাতাস ঢুকছে। আমার সাথে লেপ দুরে থাকুক, একটা গরম কাপড় নেই। ঠাণ্ডায় জমে গেছি একেবারে। নিচের বাংকে তাকিয়ে দেখি শাম্মী ওর ব্যাগ থেকে সাথে করে নিয়ে আসা দু’টা লুঙ্গি এক সাথে করে মাথা ঢুকিয়ে গিট্টু মেরে দিয়েছে। লুঙ্গি আমার খুব অপছন্দের একটা জিনিস, কিন্তু সেই প্রথম লুঙ্গি সাথে নেই বলে ব্যাপক আফসোস হলো। 
দিল্লী-তে পৌঁছে আমার কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিস্তর ঘুরে বেড়াচ্ছি। লাল কেল্লা, কুতুব মিনার, কিচ্ছু বাদ নেই। এমনকি মাঝে সিনেমা হলে গিয়ে মারদাঙ্গা দু’টা সিনেমাও দেখে ফেলেছি। সেরকম ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ একবার থেমে গিয়ে শাম্মী বললো, সবচেয়ে জরুরি কাজটাই কিন্তু করা হয় নাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী? শাম্মী আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলো সামনে, একটা বিশাল হলুদ রঙের ইংরেজি অক্ষর, এম। ম্যাকডোনাল্ডস! তখন পর্যন্ত কেবল টিভি-তেই দেখেছি, কখনও সত্যি সত্যি দেখিনি। মন্ত্রমুগ্ধের মত আমরা ঢুকলাম গিয়ে সেখানে, পেট পুরে বার্গার খেলাম। খেয়ে দু’জনেই খুব ভাব নিতে লাগলাম। হু হু বাবা, ম্যাকাস। 
অমর একুশে হলে আমার দুই রুম পরেই থাকতো শাম্মী। প্রায় প্রতি সকালে আমার ঘুম ভাঙলেই টের পেতাম আমার পায়ের দিকটায় বসে কেউ একজন পত্রিকা পড়ছে। ঘুমের ভান ধরে ইচ্ছে করেই পা দিয়ে ঠেলা দিতাম বার কয়েক। শাম্মী বিরক্ত হতো, আর যে কোন বিরক্তিতে শাম্মীর এক শব্দের প্রতিবাদ ছিল, ‘অই’! 
খুব মেধাবী ছিল ও। বুয়েটে সিভিলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু ওর জেদ ছিল কম্পিউটার নিয়েই পড়বে, পরের বছর তাই পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে চলে এলো কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে। সবসময়ে শুনে এসেছি, ও দেশে থাকবে না। ক্যানাডা চলে যাবে। পত্রিকা খুলে প্রথমেই আমরা সবাই পড়তাম খেলার পাতা। শাম্মী পড়তো, চলতি বিশ্ব। ওর কথা হচ্ছে, দেশেই যখন থাকবো না তাহলে দেশের খবর পড়ে কী হবে, এখন থেকেই বহির্বিশ্বের খবর নিয়ে তৈরি থাকা ভালো। 
তিথি-র একবার শখ হলো রান্না করে খাওয়াবে আমাকে। রোকেয়া হল থেকে রান্না হয়ে টিফিন বক্সে করে খিচুড়ি আর বিফ চলে এলো অমর একুশে হলে। আমি সেসব নিয়ে খেতে বসলাম, সাথে শাম্মী। তিথির রান্না প্রথম খাচ্ছি, আমি তো ব্যাপক আপ্লুত। শাম্মী-কে জিজ্ঞেস করলাম, কী রে, কেমন লাগছে? শাম্মী খেতে খেতেই ভাবলেশহীন হয়ে উত্তর দিলো, ভালাই, তয় কইস লবণ একটু কম হইছে! 
এরকমই ছিল শাম্মী। মনের কথা অকপটে বলে দিত মুখে। কোন ঘোরপ্যাঁচ ছিল না, মাথায় বা চিন্তায়, মনে ও না। 
একদিন রুমে ফিরে দেখি আমার বিছানায় পা গুটিয়ে চুপ করে বসে আছে। মন ভালো না, দেখেই বুঝে গেলাম। আমি এটা সেটা জিজ্ঞেস করে শেষমেশ জানতে চাইলাম, কী হয়েছে তোর? শাম্মী ওর পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে দিলো, ওর মায়ের লেখা। কী যে মায়া মাখানো ছিল সেই চিঠিটা! আমার এখনো মনে আছে চিঠির কথাগুলো। 
ওর ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল জানি, ইউনি শেষ করে শাম্মী সত্যিই দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলো। আর আজ সকালে হঠাৎ খবর পেলাম, এবারে দেশ নয় শুধু, এই জগত ছেড়েই ও চলে গেছে অনেক দূরে, না ফেরার দেশে।  
আসলে টেরই পাইনি, কবে কেমন করে যে এই বয়সে পৌঁছে গেলাম, যেখানে বন্ধু হারানোর কষ্টগুলো আস্তে আস্তে ছুঁয়ে দেয়া শুরু করবে আমাদের। শাম্মীর চলে যাওয়াটা কেমন একটা ধাক্কা দিলো মনে, হঠাৎ দুপুরে অচেনা কারও কড়া নাড়ার শব্দের মতন কেমন চমকে দিল যেন। 
হয়তো অর্থহীন আর অবাস্তব আমাদের এই চাওয়া, তবু মন থেকে চাই, আমাদের এই বন্ধুটা ভালো থাকুক। 

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-