শিবব্রত বর্মনের গল্প সংকলন- বানিয়ালুলু
এখন পর্যন্ত এ বছরে আমার পড়া সবচেয়ে চমৎকার বাংলা বই এর নাম- ‘বানিয়ালুলু’। ইচ্ছে হচ্ছে লোকেদের ডেকে এনে ধরে ধরে পড়াই বইটা।
আমাদের যাদের বাংলা কল্পবিজ্ঞানের হাতেখড়ি হয়েছে ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’ বা ‘তোমাদের জন্যে ভালবাসা’ বইগুলোর মাধ্যমে, তাঁদের কাছে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জগতে বিজ্ঞানের চেয়েও মানবিকতার পাল্লার ভার বেশি। আমি নিশ্চিত যে আমার সমবয়সী বাংলা পাঠকদের সবচেয়ে প্রিয় গল্পের নামের তালিকায় থাকবে ‘টুকুনজিল’, কিংবা ‘টুকি ও ঝাঁ এর প্রায় দুঃসাহসিক অভিযান’ অথবা ’নিউটনের ভুল সুত্র’ গল্পগুলো। বিষয় এবং গল্প বলার ভঙ্গিতে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে, তবুও বলতে দ্বিধা নেই, ’বানিয়ালুলু’ বইটি পড়তে গিয়ে বহুদিন বাদে সেই বইগুলো পড়ার আমেজ এবং আনন্দ ফিরে পেলাম।
বইয়ের প্রথম গল্পের নামই ‘বানিয়ালুলু’। এই গল্পটা পড়ে খানিকটা আশাভঙ্গ হয়। এটা যতটা না কল্পবিজ্ঞান, তারচেয়ে বেশি বেশ উচ্চমানের সারকাজম। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরের গল্পগুলো পড়তে গিয়ে টের পাই, বানিয়ালুলু নামের গল্পটা এক কথায় এই পুরো বইটির প্রস্তাবনা। লেখক এই গল্প দিয়েই যেন আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন তার তৈরি করা একটা অদ্ভুত জগতে। অনেকটা যেন বাকি বইয়ে ঢোকার আগে প্রস্তুতিপর্বের কাজ করে এই গল্পটা।
পরের প্রায় সবকটি গল্পই চমৎকার অথবা দুর্দান্ত বিশেষণে বিশেষায়িত হবার যোগ্য।
‘দুই শিল্পী’ ভাল লেগেছে, কিন্তু হঠাত করে শেষ হয়ে গেছে মনে হলো। ‘প্রতিদ্বন্ধী’ পড়ে লেখকের কল্পনাশক্তির বিস্তার দেখে অভিভূত হয়েছি। মনে মনে বেশ কয়েকবার অজান্তেই প্রশংসা করেছি গল্প এগিয়ে নেবার পারদর্শিতার। বেশ কিছু গল্পে লম্বা বর্ণনা দিয়েছেন লেখক, গল্পের মূলে ঢুকবার আগে। যেমন ধরা যাক ‘ডঃ মারদ্রুসের বাগান।’ সেই বর্ণনাগুলো ঝুলে যাবার একটা আশংকা ছিল, কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম শেষমেশ আগ্রহ ধরে রেখে পুরো গল্পটা টেনে নিয়ে যেতে পেরেছেন তিনি, অতিরিক্ত মনে হয়নি আর সেগুলো। সবচেয়ে বড় কথা, যে বাগানের আপেল অথবা কমলাগুলো আসলে শেক্সপিয়রের সনেট, সে বাগানে আরেকটু লম্বা সময় কাটাতে পারলে ক্ষতি নেই।
‘ভেতরে আসতে পারি?’, ’দ্বিখন্ডিত’ এবং ’বহুযুগের ওপার হতে’ সবগুলোই খুব ভাল মানের গল্প। খেয়াল করে দেখলাম, একেবারে নতুন বিষয়ে লেখা গল্পে লেখক যেমন দক্ষ, তেমনই গল্পের বিষয় যেখানে পুরনো- সে গল্পের বর্ণনায় তিনি সাবলীলভাবে নতুন কোন ভঙ্গি নিয়ে এসেছেন।
বইটিকে পাঁচের ভেতর নির্দ্বিধায় সাড়ে চার দিব আমি। লেখক শিবব্রত বর্মনের লেখা আগে পড়িনি কখনো, কিন্তু এখন থেকে তিনি আমার অবশ্যপাঠ্যের তালিকায় পাকাপাকি জায়গা করে নিলেন।