মন্তব্য-পোষ্টঃ বদরুদ্দীন উমরের কলাম পড়ার পরে-

জুবায়ের ভাইয়ের লিংক থেকে গিয়ে সমকালে ছাপা হওয়া জনাব উমরের লেখাটি পড়লাম। সোজা বাংলায় বললে বেশ আক্রমণাত্মক একটা লেখা, বিষয় এবং লেখার ভাষা- দু দিক থেকেই।
পড়া শেষ করে কিছু ব্যাপারে কনফিউশান রয়ে গেছে। যেমন, উমর বললেন, ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত কোন স্মৃতিচারণ করা হয় নি, কারণ ব্যাক্তিগত প্রচার কেউ চাইতেন না।
স্মৃতিচারণ না করাটা সাধুবাদের যোগ্য কি না এই নিয়ে আমি খানিকটা দ্বিধায় আছি। এবং আন্দোলনের পরের বছর থেকেই এই নিয়ে 'বিরাট কিছু করে ফেলেছি' জাতীয় মনোভাব আসাটাও বাস্তবসম্মত নয়। আমার ধারণা, এরকম বড় ঘটনাগুলোর মুল মর্ম ঠিকঠাক উপলব্ধিতে আসে অনেকটুকু সময় পেরিয়ে গিয়ে যখন পেছনে ফিরে তাকানো হয়, তখন। তার আগে খুব নিকট সময়ে হয়তো ভালো মতন আলো ফেলাটা দুরুহ হয়ে ওঠে।
সে সময়ের ফেব্রুয়ারির সাথে এ সময়ের ফেব্রুয়ারির পার্থক্যের জন্যে ওনার খারাপ লাগাটা বুঝতে পারি, কিন্তু এটাও কি বাস্তবসম্মত নয়? তখন আর এখনকার পরিপ্রেক্ষিত কি মানুষের কাছ থেকে একই আচরণ দাবী করে? সেই সময় আমাদের নিজের একটা দেশ ছিল না, নিজেদের মৌলিক অধিকারগুলোও বাস্তবায়িত হচ্ছিলো না ঠিকমত, সেই সময়ে আমাদের অন্যতম সাফল্য ছিলো ভাষা আন্দোলন, এবং তাই সেটাকে সামনে রেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পুরো মাসটাতেই প্রতিরোধ ধরণের মনোভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাভাবিকতা এখনো আশা করা যায় কি না, সেই নিয়েও দ্বিধায় আছি।

অবশ্য, রাত বারোটায় শহীদ মিনারে যাওয়াটা আমারও পছন্দ নয়। জনাব উমরের সাথে একমত এক্ষেত্রে, প্রভাত ফেরীর আবেদনটাই আলাদা। যেটা এখন একদমই পোশাকি হয়ে গেছে রাজনৈতিক দল আর টিভি ক্যামেরার বদৌলতে।

জনাব উমর লেখার এক পর্যায়ে বলেছেন- ভাষাসৈনিকদের সংখ্যাবৃদ্ধির কথা। উনি লিখেছেন, প্রাকৃতিক ভাবে ভাষাসৈনিকদের সংখ্যা কমে যাবার কথা ছিলো, কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা।
আমার ধারণা, এটার কারণ অন্যরকম হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ঢাকা মেডিকেলের পাশেই আটকে ছিলো- আমাদের সব লেখালেখি, গল্প প্রবন্ধ ইতিহাস সবই ছিলো শহীদ মিনার কেন্দ্রিক। এখন পত্রিকাগুলোর চেষ্টায় কিছুটা তার বাইরে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ চলছে। এ কারণেই এতদিন পর্যন্ত যারা ফোকাসে ছিলেন না, তাদের অবদানগুলো উঠে আসছে।
এই উঠে আসার ক্ষেত্রে কিছু মিথ্যের মিশেল ঘটে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে, এ কথা সত্যি। জনাব বদরুদ্দীন উমরও তার কলামে এই নিয়েই আক্ষেপ করেছেন।
তবে আমার কথা হলো- এই মিথ্যেগুলোকে তো আলাদা করবার সুযোগ রয়েইছে আমাদের হাতে। সে সময়ে অন্য যারা ছিলেন, তারা তো এই ব্যপারগুলো জাস্টিফাই করতে পারেন। মিথ্যে হবার সুযোগ আছে বলেই যে আমরা সে দিনের ঘটনাগুলো আর কারো কাছ থেকে জানতে চাইবো না- এরকম অভিমত ভালো লাগে নি। দ্বার বন্ধ করে ভ্রমটাকে রুখতে গিয়ে সত্যটাকে আটকে দেবার সেই সরল সিধা ভাবসম্প্রসারণই মনে পড়ে গেলো।

প্রাসঙ্গিক এক অংশে উমর লিখেছেন, সেই সময়ের পোষ্টার মারা লোক, এমনকি পোষ্টার পড়া লোকও ভাষা সৈনিকদের কাতারে!
শেষোক্ত কথাটি (পোষ্টার পড়া লোক) শ্লেষ আর বিরক্তি থেকে বলা ধরে নিয়ে বলি, সেই সময়ে সরকারী বাঁধা পাত্তা না দিয়ে দেয়ালে পোষ্টার মারাটা কি খুব সহজ কাজ ছিলো? আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে এই ব্যাপারটিকেও খুব ছোট কিছু বলে মনে হয় নি। সে সময়ে চেতনা থেকে নয়, পেশাগত কারণেও যদি কেউ পোষ্টার মেরে থাকেন, তাহলেঅ তার সাহসের তারিফ করতে হয়। অন্তত আমার মত সাধারণ মানুষেরা এটাকে অনেক বড় করেই দেখি। জনাব উমরের কাছে এ ব্যাপারটি গুরুত্ব পায় নি কেন বুঝতে পারি নি। শুধু গুরুত্বহীন নয়, লেখার ভাষা বলে, অনেক বেশি অবজ্ঞাও করেছেন তিনি।

সর্বশেষ, ভাষাসৈনিক শব্দের সৈনিক নিয়ে আপত্তি।
উমর দেখিয়েছেন এ ব্যপারটির শুরু সামরিক শাসনের সময় থেকে। বাকিটা বলেন নি, কিন্তু আমরা ধারণা করতে পারি তিনি বুঝিয়েছেন- ওই সময়ে কিছু চাটুকারশ্রেণীর লোকজনের উদ্যোগেই এ ধরণের শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে।
এইখানে আমি যেটা বুঝি, এ ধরণের যে কোন উপাধি-র সাথে আবেগ জড়িত থাকে। সেই আবেগটা কতটুকু আসল বা নকল এটা আমাদের 'বুঝে' নিতে হয়। এ কারণেই বিদ্যাসাগর, শেরে বাংলা বা বঙ্গবন্ধু এক কাতারে থাকে, আর অন্যদিকে থাকে পল্লী-বন্ধু, ভাষা কন্যা এই জাতীয় উপাধিগুলো। স্পষ্টতঃ উনি ভাষাসৈনিক শব্দটাকে দ্বিতীয় কাতারে ফেলেছেন। এইখানে আমার প্রশ্ন, আমাদের অন্য বুদ্ধিজীবিদেরও তাই মত? নাকি শুধু বদরুদ্দীন উমর সাহেবই এমনটা ভাবেন? এটা জানা দরকার এ কারণে যে, চাটুকারদের দেয়া উপাধি সময়ের সাথে সাথে লোকে আপনা থেকেই ঝেড়ে ফেলে দেয়, কারও আর মনে থাকে না, ব্যবহার তো দুরে থাক। সেই দিক থেকে বলা যায় ভাষাসৈনিক শব্দটা তবে বিরাট ব্যতিক্রম? নাকি এটা সত্যিই মানুষের মন থেকে দেয়া উপাধি ছিলো? নইলে এতদিন পরে এখনো কেন লোকে অবলীলায় সেই শব্দ ব্যবহার করে চলছে? এক সামরিক শাসন থেকে আরেকটায় এসে পড়বার আগে আমরা মধ্যিখানে লম্বা সময় 'গণতান্ত্রিক দেশ' ছিলাম, এটা ভুলে গেলে চলবে না।
আরেকটা সংশয় যেখানে, সৈনিক কথাটা ব্যবহারে এত আপত্তির কারণ কি হবে? সৈনিক শব্দটা কি শুধুই আমাদের দেশের সামরিক বাহিনীর ড়্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত কোন শব্দ? আমার তো মনে হয় না। সৈনিক শব্দটা আমাদের জীবনের প্রেক্ষিতে, অথবা জীবন সংগ্রামের প্রেক্ষিতে আমাদের প্রত্যেকের জন্যেই গুরুত্ব রাখে অনেক। সে তুলনায় ভাষা নিয়ে আন্দোলন তো এক ধরণের যুদ্ধই ছিলো বলা চলে। তাহলে সেই যুদ্ধের যোদ্ধারা ভাষাসৈনিক হলে দোষ কোথায়? নাকি ভাষাযোদ্ধা হলে ঠিক হত? আমার ধারণা শ্রুতিমধুরতারও একটা ব্যাপার আছে। এ কারণেই মুক্তিসৈনিক না হয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, আর ভাষাযোদ্ধা না হয়ে ভাষা সৈনিক।
এটাই স্বাভাবিকতা। সামরিক বাহিনী প্রিয় নয় বলেই যেখানেই সৈনিক শব্দটির উল্লেখ পাবো, সেখানেই তাদের গন্ধ খুঁজে বেড়াবো- এরকম মানসিকতা বাড়ির আড্ডায় বসে চা খেতে খেতে শুনলে ঠিক শোনায়, কিন্তু পত্রিকায় কোন বুদ্ধিজীবির কলামে এ কথা পড়লে ঠিক যেন হজম হয় না। পুরো কলামটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, উনি খুব বেশি একপেশে মনোভাব নিয়ে লিখেছেন। সবকিছুকে সরলীকরণ-অথবা আরো ভালো বলা যায়-খারাপীকরণ করে ফেলেছেন তিনি। এই সব ব্যাপারগুলোরই ভাল মন্দের ভারসাম্য বজায় রেখে একটা সুন্দর কলাম লেখার সুযোগ ছিলো, কিন্তু তিনি শুধুই মন্দটুকুই তুলে ধরেছেন, ভালো দিকগুলো ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয়- হয়েছে পুরোপুরি উপেক্ষিত।

বদরুদ্দীন উমরের কলাম পড়ে এত এত প্রশ্ন আর সংশয় মনে আসতেই একটা দুঃখবোধও জাগ্রত হলো- কেন যে ভদ্রলোক সচলায়তনে ব্লগিং করেন না! এখন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কেমনে পাবো?

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-