আশ্চর্য তীর্থযাত্রীরা -০১

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের বারোটি ছোটগল্প নিয়ে একটা সংকলন, ইংরেজি নাম স্ট্রেইন্জ পিলগ্রিমস
পিলগ্রিমসের দুইটা মানে করা যায়। এক হলো পর্যটক, বা অভিযাত্রীও বলা যায়। অন্যটা হলো তীর্থযাত্রী। আমি ভাবছিলাম, এই বইয়ের বাংলানুবাদ কেউ যদি করতে চায়, কোন মানেটা বেছে নেবে?
ঠিক এই নামে বইয়ে কোন গল্প থাকলে খানিকটা সুবিধা হতো। তখন গল্পের গল্প বা ভাবগতিক দেখে বুঝে নেয়া যেত, অভিযাত্রা নাকি তীর্থযাত্রা, কোনটা আসল উদ্দেশ্য।

আমি অবশ্য ভেবে নিলাম, তীর্থযাত্রা-ই ভাল শোনাবে। কল্পনাটা এরকম যে, গল্পগুলো নানান চরিত্র, তাদের বর্ণনা এবং এইসব বিবরণের প্রয়োজনে একগাদা বাক্যের সমষ্টি- এই পুরো ব্যাপারটা শেষ-মেষ যেখানে যেতে চাইছে, সেটা হলো- একটা গল্প হয়ে ওঠা। অনেকটা তীর্থ-দর্শনের প্রতিজ্ঞা নিয়েই যেন গল্পগুলোর এগিয়ে যাওয়া। এইরকম ভাবনা মাথায় এনে আমি নিজের মনেই রায় দিলাম- স্ট্রেইন্জ পিলগ্রিমসের ঠিকঠাক বাংলা করতে বললে, আমি এটাই বলবো- আশ্চর্য তীর্থযাত্রীরা

বইয়ের গল্পগুলো পড়তে গিয়ে ভাল-মন্দ দুইই লাগছিলো। তবে সে সব নিয়ে আলাপ করা আমার উদ্দেশ্য নয় এখন। ঘটনা হলো, বইয়ের শুরুতে লেখক কর্তৃক লিখিত ভূমিকাটুকু পড়ে চমৎকার লেগেছিলো, এবং পড়তে পড়তেই ভাবছিলাম এটাকে বাংলা করে ফেললে কেমন হয়?

কেমন যে হয়, সেটা আসলেই চিন্তার বিষয়। অনুবাদ কখনো করিনি, অবশ্যই ইশকুলের ব্যাকরণ পরীক্ষার খাতা বাদে। আর, মার্কেজের লেখা বা এ জাতীয় ভাবগম্ভীর লেখা-পত্র নিয়ে এই দুঃসাহস দেখাতে গেলে আমার অল্পবিদ্যা ফাঁস হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। পিস অব কেইক-কে আমি সত্যিই পিঠার টুকরো লিখে বসতে পারি। এইসব ভেবে টেবে বুঝে নিলাম, অনুবাদ আসলে আমাকে দিয়ে হবে না মনে হয়, যেটা হবে, তা হলো, এই যে পড়লাম, এই পড়া নিয়েই খানিক্ষণ বসে বসে গ্যাজানো আর কি!

যা বলছিলাম, এই বইটির মোট বারোটি গল্পের অন্তত তিনটি আমার কাছে চমৎকার লেগেছে, দুইটি একেবারেই ভাল লাগেনি আর বাকি সাতটি মোটামুটি। এইরকম নানান স্বাদ পাবার পেছনের কারণগুলি নিয়ে লিখতে পারলে খুব ভাল হতো, আলস্য কাটিয়ে কখনো যদি সময় পাই, লিখে ফেলবো বলে আশা করি, তবে আপাতত সেই প্রসংগ থাক, ভূমিকায় ফিরে আসি।

লেখক ভূমিকারও একটা শিরোনাম দিয়েছেন, এবং সেটাও বেশ কৌতুহলদ্দীপক। শিরোনাম হলো- কেন বারোটি, কেন গল্প, আর কেনই বা তীর্থযাত্রী?
এই শিরোনাম নিয়ে ভাবতে গিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়লাম। সম্ভবত এই প্রথম আবিষ্কার করলাম, বাংলা আর ইংরেজি এই দুই ভিন্ন ভাষায় বহুবচনের আচরণ বেশ আলাদা। ঠিকঠাক অর্থ বুঝে নেয়া যায়, কিন্তু লিখতে গেলে বেশ ভাবনায় ফেলে দেয়। যেমন - গল্পের বইয়ের নাম আমি "আশ্চর্য তীর্থযাত্রীরা" ভেবে নিয়েছি, পিলগ্রিমস এর বঙ্গানুবাদ হিসেবে, কিন্তু ভূমিকার শিরোনামে ওই একই পিলগ্রিমস-এর বিপরীতে তীর্থযাত্রীরা লিখতে মনে সায় দিলো না। এখানে মনে হলো, বহুবচনের বদলে একবচন ব্যবহার করাই ভাল হবে। তাই ঠিক করলাম, শিরোনামের বাংলা এভাবেই পড়বো- কেন বারোটি, কেন গল্প, কেনই বা তীর্থযাত্রী?

ভূমিকার শুরুতে লেখক সরল কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। আমাদের পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের রীতি অনুযায়ী ব্যাপারটা কি এরকম "নামকরণের স্বার্থকতা" জাতীয় কিছু দাঁড়ায়? হয়তোবা। শুরুটুকু এরকম-

এই বইয়ের বারোটি গল্প লেখা হয়েছে গত আঠারো বছর ধরে। বর্তমান অবস্থায় পৌঁছবার আগে এদের পাঁচটি ছিলো জার্নালিস্টিক নোট ও চিত্রনাট্য, এবং একটি ছিলো টেলিভিশনের ধারাবাহিক। বছর পনের আগে একটি সাক্ষাৎকার রেকর্ডের সময় আমি আরেকটি গল্পের বর্ণনা দিয়েছিলাম, পরে যেটি আমার বন্ধু অনুলিখন করে ছাপিয়েছিলো, এবং এবারে আমি সেটিকে তার বর্ণনা অনুসারেই পুনর্লিখন করেছি। এই পুরো প্রক্রিয়াটাই আমার জন্যে একটা আশ্চর্য সৃজনশীল অভিজ্ঞতা, যেটা ব্যাখ্যা করা দরকার। দরকার একারণেই যে, আজকের শিশু-কিশোররা যারা লেখক হতে চায়, তারা বড় হয়ে জানতে পারবে লেখার অভ্যাসে কতখানি অতৃপ্তি ভর করে থাকে আর কতখানি ঘষা-মাজার প্রয়োজন হয় তাতে।

এইটুকু পর্যন্ত বাংলা করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার সীমালংঘন করে ফেললাম। মার্কেজ প্রায়শই দীর্ঘ বাক্য ব্যবহার করেন, গল্পেতো বটেই, এমনকি ভূমিকাতেও তার ব্যাতিক্রম নয়। সেই দীর্ঘ বাক্যের সঠিক অনুভুতি বাংলায় আনতে গিয়ে আমি একটা বাক্যের মাঝখানে একটা দাড়ি বসিয়েছি, এবং ইংরেজিতে যেখানে পাশাপাশি দুটি শব্দ বসিয়েই একটা বিষয়কে বর্ননা করা হয়েছে, আমি সেখানে আলাদা ভাবে দুটি শব্দের তরজমা করে একটা দীর্ঘ বাক্যে রূপান্তর ঘটিয়েছি। এইরকম রকম কারিগরি অনুবাদে জায়েজ আছে কিনা কে জানে। যাকগে, আরেকটু এগুই, দেখা যাক কি হয়।

প্রথম গল্পটির পরিকল্পনা আমার মাথায় আসে সত্তরের দশকের শুরুতে, একটা প্রদীপ্ত স্বপ্নের ফলাফল হিসেবে, যেটি আমি দেখেছিলাম বার্সেলোনায় পাঁচ বছর থাকার পর।

এই লাইন নিয়ে একটু গোলমালে পড়েছিলাম। প্রথমবার পড়ছিলাম এভাবে যে, গল্পের পরিকল্পনা মাথায় আসে বার্সেলোনায় পাঁচ বছর থাকার পর একটা স্বপ্নের ফল হিসেবে। কিন্তু এভাবে পড়তে গিয়ে দেখি, গল্প আর স্বপ্নের মধ্যবর্তী দুরত্ব অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে, যেটা ভাবটাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তখন এদের দুরত্ব কমিয়ে আনলাম, একটার বদলে দুটি কমা দিলাম, এবং এইবার এই বাক্যের চেহারা আমার বেশ পছন্দ হলো।

আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম যে আমি আমার নিজের শেষকৃত্যে অংশ নিচ্ছি, গম্ভীর শোকাবহের পোষাকে বন্ধুদের সাথে হেঁটে বেড়াচ্ছি কিন্তু খানিকটা যেন উৎসবের মেজাজে। একত্র হতে পেরে আমাদের সবাইকেই খুব খুশী দেখাচ্ছিলো। এবং অন্য যে কারো চেয়ে বেশী খুশী ছিলাম আমিই, কারণ মৃত্যু আমাকে আমার ল্যাটিন আমেরিকার বন্ধুদের সাথে মিলিত হবার সুযোগ করে দিয়েছিলো, আমার সবচেয়ে পুরনো আর সবচেয়ে ভালো বন্ধুরা, যাদের আমি বহুদিন ধরে দেখি না। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে সবাই যখন বিদায় নিচ্ছিলো, আমিও চলে যেতে উদ্যত হলাম, কিন্তু তখন তাদের একজন আমাকে চূড়ান্তভাবে বুঝিয়ে দিলো যে আমার আনন্দ-অনুষ্ঠান ওখানেই শেষ। সে আমাকে বললো, " তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে এখান থেকে যেতে পারবে না।" আর কেবল তখুনি আমি বুঝতে পারলাম যে মরে যাওয়া মানে আর কখনোই বন্ধুদের সাথে একত্র হতে না পারা।

এই প্যারাটা বেশ তরতরিয়ে এগুলো দেখা যাচ্ছে, যদিও এবারই প্রথম আমি কমা দেবার পরিবর্তে মূল লাইন থেকে একটা কমা তুলে দিয়েছি। এবং এবারই প্রথম আমার খানিকটা সন্দেহ হলো, আমি কি এই লেখাটার অর্থ ঠিকঠাক ধরতে পারছি?


(ক্রমশঃ )

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-