সত্যজিৎকে নিয়ে | শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

একটানা একটাই বই পড়ে যাওয়ার আনন্দ, অনেকদিন হলো, পাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠছিল না। সমস্যা আমারই, একই সঙ্গে কয়েকটা বই পড়তে থাকি। সেগুলোর অবস্থানও ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়; কোনোটা বিছানার পাশের সাইডটেবলে, তো কোনোটা কাজের টেবলের ওপরে। একটা ফোনে তো অন্যটা কিন্ডলে। যখন যেখানে পড়তে সুবিধা হয় আর কি। 


এই অনভ্যাসের মধ্যেও এই বইটা টানা পড়ে শেষ করে ফেললাম। ছোট বই, লকডাউনের জন্যে বাসায় বন্দী- যখন যে রুমে গিয়েছি সাথে করে নিয়ে ঘুরেছি। 



বইটির নাম 'সত্যজিৎকে নিয়ে'- কারণ হিসেবে এটাই আসলে যথেষ্ঠ। কিন্তু তার সঙ্গে লেখকের কৃতিত্ব না দিলে অন্যায় হবে। শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের অনেক গুণ, তিনি গল্প উপন্যাস লিখেন, আবার সাংবাদিক, সেই সাথে সংগীতজ্ঞও বটে। 


এই বইটি মূলত সত্যজিতের কয়েকটি সাক্ষাৎকারের সংকলন, শঙ্করলালের নেয়া। এবং সেই সাথে কয়েকটি পত্রিকায় ছাপা হওয়া নিবন্ধও রয়েছে। বলা বাহুল্য সেগুলোও সত্যজিৎ সম্পর্কিত। 


শঙ্করলালের বর্ণনায় সাংবাদিকসুলভ 'টু দ্য পয়েন্ট' টোনের বদলে বরং লেখকসুলভ একটা আরামদায়ক অলসতা খেয়াল করলাম। শুরুর লেখাটায় সত্যজিতের বসার ঘরে বসে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে কী কী চিন্তা মাথায় ঘুরছিল, সে সবেরও একটা সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। 


সত্যজিতের অন্যান্য সাক্ষাৎকার আগে যা পড়েছি, সেখানে তাঁর নিজের কাজ নিয়ে আলাপ ছিল বেশি। কিন্তু এই বইটিতে বেশি এসেছে সত্যজিতের নিজের পড়া বই বা দেখা সিনেমার প্রসঙ্গ। অনেকটা তাঁর নিজের গড়ে ওঠা বেশি ফোকাসে ছিল। কেমন করে তিনি মোজার্ট বা বেটোফেনের অনুরাগী হয়ে উঠলেন, ধীরে ধীরে- এবং তাঁর সংগীতপ্রেম নিয়ে দীর্ঘ আলাপ পড়া হলো সেই সুবাদে। 


সাক্ষাৎকারের গৎবাঁধা ভাবটা অনুপস্থিত থাকাতেই বইটি পড়তে হয়তো খুব ভালো লাগছিলো।  


প্রসঙ্গ এসেছে রবীন্দ্রনাথ এবং বিনোদবিহারীর। শান্তি নিকেতনে আড়াই বছর কাটিয়ে  পড়াশোনা শেষ না করেই চলে এসেছিলেন, কারণ ফাইন আর্টিস্ট হবার মেধা তাঁর নেই, এরকমটা নাকি মনে হচ্ছিলো! ত্রিশ বছর বয়সে করেছেন 'পথের পাঁচালী'। আর তেত্রিশে 'দেবী'। 

অল্প দু'তিন লাইনে উঠে এসেছে তাঁর গল্প লেখার প্রক্রিয়াও। কেমন করে গল্প আর চরিত্র নিয়ে অনেক ভাবেন। ভাবতে ভাবতে সেগুলো মাথায় খুব করে জেঁকে বসলে সারাদিন ধরে টানা লিখে গল্প শেষ করেন, প্রায়শই সেটা হয় এক দিনেই। 


আর ভীষণ ঘরকুনো ছিলেন। নিজের কাজের ঘরেই বসে বসে লেখা আর আঁকার সব কাজ করতেন তিনি। সিনেমার কাজ বাদে খুব একটা বাইরে বেরুতেন না। 


বইটিতে 'ফেলুদার দাদা-দিদিরা' নামে একটা লেখা আছে। শঙ্করলাল এটিতে একই সাথে হোমস, মার্পল, পোয়ারো এবং মেগ্রে- জনপ্রিয় এই গোয়েন্দা চরিত্রগুলোর সমান্তরালে ফেলুদা-কে রেখে একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। খুব মজা লাগলো পড়ে। 


সত্যজিৎ রায়-কে নিয়ে আগ্রহীরা খানিকটা ভিন্ন কিছু পড়তে চাইলে এই বইটি সুপারিশ করবো আমি।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-