হাওয়াই মিঠাই ১৭: নেপালি পরিবার

ডারবানে পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই সোজা আমার ডিপার্টমেন্টে চলে গেলাম। সব সময়ের মত ওখানেও আমি লেইট, ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে এক সপ্তাহ আগেই। আমার ভিসা অফিসার কুম্ভকর্ণের মত দ্রুতগতিসম্পন্ন হওয়ায় আমার প্লেনে চাপতেও দেরি হয়ে গেলো।
ইউনি-র কোন একটা হল-এ থাকবো আমি। জানা আছে আগেই, কিন্তু তার আগে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে কাগজ পত্রের ফর্মালিটি সারতে হবে।
অফিসের করণিক মহিলা হাসিমুখে আমাকে একটা ফরম দিলো, সেই ফরম পূরণ করতে গিয়েই লাগলো প্রথম গোলযোগ। নাম-ধাম ঠিকানা পরিচয়ের পরে একটা ঘর আছে সেখানে, এথনিসিটি। পৃথিবীর আর কোন দেশে এই অদ্ভুতুড়ে তথ্য জানতে চায় কি না জানি না, কিন্তু ওদের ওখানে এটাই স্বাভাবিক।
অপশান মাত্র চারটা। সাদা, কালো, কালারড এবং ইন্ডিয়ান।

তো আমি এইখানে এসে খানিকটা থমকে গেলাম, এর কোনটাই তো আমি নই।
অফিসের দরজাটায় চমৎকার বাহারি কাঁচ লাগানো। সেখানে, নিজের প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে আমি কলম কামড়াচ্ছি আর ভাবছি, এইখানে কী লিখবো? সাদা নই আমি, কালোও নই, ইন্ডিয়ান তো নইই। সুতরাং আরও খানিক ভেবে টেবে আমি ‘কালারড’ অপশানে টিক দিয়ে ফরম জমা দিয়ে দিলাম।
ছবির মতন বাঁধাই করা মুখে মহিলা আমার ফরম চেক করতে লাগলো। কিন্তু যেই না এথনিসিটিতে চোখ পড়েছে অমনি একেবারে হা হা করে উঠলো। বললো, ‘তুমি কালারড লিখেছো কেন?’
আমি বললাম, ‘তো? কী লিখবো?’
বললো, ‘কেন, ইন্ডিয়ান?’
আমি মুখ গম্ভীর করে ফেললাম, ‘উহু, তুমি ভুল করছো, আমি বাংলাদেশি।’
মহিলা এইবারে হেসে আমাকে বলে, ‘তা তো ঠিকই আছে, আমি তো জানিই তুমি বাংলাদেশি, কিন্তু তোমার অরিজিন তো ইন্ডিয়ান, তাই না?’
আমি তখনও ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘না। আমার অরিজিনও বাংলাদেশি। আমি ইন্ডিয়ান নই। তোমাদের এখানকার সাদাদের মত সাদাও নই, আবার কালোদের মত কালোও নই। আমার গায়ের রঙ অনুযায়ী আমাকে খুব বেশি হলে যেটা বলা যায় সেটা হলো ‘কালারড’।’
মহিলা খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। পরে ঠোঁট উলটে বললো, ‘কী মুশকিলে ফেললে বলো তো। কেমন করে যে তোমাকে বোঝাই।’
আসলে পরবাসে সেটাই আমার প্রথম দিন ছিলো, মহিলা সে জন্যে বোঝাতে পারেনি আমাকে। কিন্তু তারপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিদিন অনিচ্ছাস্বত্তেও বুঝে গেছি ইন্ডিয়ান বলতে এরা যা বোঝে, সেটা কেবলই আমাদের প্রতিবেশি দেশের লোকেরা নয়, এর মানে পুরো উপমহাদেশের সবাই।
আমার মতন আর সব প্রবাসী বাংলাদেশিদের বোধকরি এরকম অভিজ্ঞতা প্রচুর।
প্রথম দেখাতেই হিন্দিতে কথা বলে ফেলে, এটা আমার প্রায় প্রতিদিনকার ঘটনা। বেশিরভাগ সময়েই হাসিমুখে জানান দেই যে আমি ভারতীয় নই, মাঝে মাঝে বিরক্তও হই। দু একজন সর্দারজী আবার উৎসাহের আতিশয্যে পাঞ্জাবীও চালিয়ে দেয়।
গায়ের রঙ নিয়ে আরেকটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল।
ডারবানেই থাকতাম তখন। আমার কিছু মালদ্বীপিয়ান বন্ধু হয়েছিলো সেখানে। গায়ের রঙ কাছাকাছি, তার উপরে রমজান মাসে আমরা একসাথে ইউনির মসজিদে বসে মোঘলাই ইফতারি সাবাড় করি, সব মিলিয়ে খাতির ভালই। ওদের একজনের নাম সুমাইস।
একদিন ইউনির কম্প্যু ল্যাবে ইন্টারনেট ঘাঁটছি। হঠাৎ করে শুনি কে যেন দরজার কাছ থেকে আমার নাম ধরে ডাকছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা মুশকো ইউরোপিয়ানকে সাথে নিয়ে সুমাইস দাঁড়িয়ে। আমি মুখে প্রশ্ন নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লাম। ও হাসিমুখে হাত ইশারায় বোঝালো, ঠিক আছে, উঠতে হবে না। আমিও হাসি ফিরিয়ে দিয়ে কম্প্যুতে মন দিলাম।
পরে ওর সাথে দেখা হলে আমাকে বললো, ‘তোমাকে কেন ডেকেছিলাম জানো?’ আমি বললাম, ‘কেন?’ সুমাইস বললো, ‘ আমার সাথের ঐ ছেলেটা বলছিলো বাংলাদেশিরা নাকি কালো হয়। আমি তাই তোমাকে দেখিয়ে ওর ভুল ভাঙিয়ে দিলাম, বাংলাদেশিরা সাদাও হয়!’
ঠিক এর উলটো একটা ঘটনা ঘটেছিলো মেলবোর্নে এসে।
কাজের ফাঁকে খাবার খেতে খেতে আড্ডা চলছে। আমার সহকর্মী, মেয়েটা লিবিয়ান বা লেবানীজ, ঠিক মনে নেই। কী একটা ঘটনা বলছে সবাইকে, “ জানো, তারপরে হলো কী, একটা লোক এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো..., খুব কালো ছিলো লোকটা, একদম এই যে, এই তারেকের মতো কালো।’’
হা হতোস্মি!
ছাত্র থাকাকালীন কামলা খাটতাম প্রচুর। নানা জায়গায় নানা কাজের অভিজ্ঞতা ঝুলিতে জমানো আমার। এরকম এক জায়গায় কাজের সময় এক বাংলাদেশি ভদ্রলোক প্রথম দেখায় আমার মুখে বাংলা শুনে চমকে উঠেছিলেন। অনেকদিন বাদে জানলাম, উনি ভেবেছিলেন আমি মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের লোক।
আবার আমি নিজেও এরকম কান্ড করেছিলাম।
আরেক জায়গায় বেশ কিছুদিন কাজ করি আমরা দুই বাঙালী, অন্যজন ছুটিতে গেলো দু সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে আরেকজন এসে যোগ দিলো কাজে। সেই ভদ্রলোকের নাম শুনে এবং চেহারা দেখে আমার কেন যেন মনে হলো সে ব্যাটা নির্ঘাত পাকিস্তানী। টানা দু সপ্তাহ থমথমে মুখ করে আমরা দুজন দুজনের সাথে ইংরেজিতে কথা চালিয়েছি। দুসপ্তাহ পরে ছুটি শেষে আমার বাঙালী সহকর্মী ফেরত এসে আমাদের দু’জনকে ইংরেজিতে কথা বলতে দেখে চমকে গেলো! অতঃপর বাংলাদেশি হিসেবে নতুন করে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। হাসি
এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটনা বললাম, তার প্রায় সবই কাছাকাছি। একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতাও হয়েছে।
মেলবোর্ন মূল শহর থেকে বাসায় ফিরবো ট্রেনে। ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট স্টেশানের একটা বেঞ্চে একা একা বসে আছি। এমন সময় আমার পাশে এক বুড়ি চাইনিজ মহিলা এসে বসলো। আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখি খানিক পর পর আমার দিকে হাসিমুখে তাকাচ্ছে। আমি একটু সাবধান হলাম। কদিন আগেই এখানে এক খ্রিস্টান ‘তাবলিগি’র সাথে দেখা হয়েছিলো। ভদ্রলোক আরেকটু হলেই আমার হাতে ‘হ্যাভেন’ এর টিকেট ধরিয়ে দিচ্ছিলো, এই মহিলা সেই গোত্রীয় কি না তা-ই ভাবছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ লাগলো না ভুল ভাঙতে। মিনিট দুয়েক যেতেই মহিলা আমার আরেকটু পাশ ঘেঁষে বসল, তারপর ব্যাগ থেকে একটা চীনে হরফে লেখা কাগজ বের করে নিয়ে আমাকে দেখিয়ে একদম ‘খাস’ চাইনিজে কী যেন জিজ্ঞেস করতে লাগলো! আমি তো হতভম্ব। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি, পরে হাত পা নেড়ে তাকে ইংরেজিতে বললাম, তুমি কী বলছো আমি কিছুই বুঝছি না।
সেই বুড়ি মহিলা এবারে তেলেবেগুণে জ্বলে উঠলো। আরও খানিকক্ষণ চাইনিজে তুবড়ি ছুটিয়ে সমাপ্তি টানলো চারটা বোধগম্য শব্দে, ‘ হোয়াই টক ইংলিশ? চাইনিজ চাইনিজ’!
আমি সেদিন বাড়ি ফিরে আয়নায় বারবার নিজের ভুতের মতন ভেসে থাকা মণিওয়ালা চোখ আর ভোঁতা নাক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলাম, ঠিক কোন কোণা থেকে তাকালে আমাকে চাইনিজ মনে হয়? কে জানে!
আমার বউয়ের বোঁচা নাক নিয়ে বিয়ের আগে থেকেই ওকে নিয়মিত ক্ষেপাই। সেটা পূর্ণতা পেল মেলবোর্নে এসে।
অফিসে বসে আছি। শেষ মুহুর্তের কাজ, দ্রুত শেষ করে উঠবো। তখুনি আমার এক নেপালিজ সহকর্মী আমার কাছে এসে খুব উৎফুল্ল স্বরে আমাকে বলে, ‘জানো জানো, আমাদের অফিসে না একটা খুব মিষ্টি দেখতে নেপালিজ মেয়ে ঘুরঘুর করছে!’
আমি বললাম, ‘তাই নাকি? কই দেখে আসি।’
বাইরে গিয়ে দেখি আমার বউ এসে বসে আছে, কাজ শেষে একসাথে বাড়ি ফিরবো তাই।
ফিরে গিয়ে বললাম, ‘ব্যাটা হাঁদারাম, ওইটা নেপালিজ কেউ না, ওইটা আমার বউ।’
সেই ছেলে এইবার জিবে কামড় দিয়ে বললো, ‘স্যরি মাইট, কিন্তু ও দেখতে একদম নেপালিজ!’
সে কথা মনে করে আমরা প্রায়ই হাসাহাসি করি।
আজ ঘটলো সর্বশেষ ঘটনা।
কার পার্কে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, বৃষ্টিটা একটু ধরে এলেই দৌঁড় দিবো গাড়ির কাছে। তখন এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে খুব সংকোচের সাথে আমাকে কী যেন জিজ্ঞেস করলো। ভাষা বুঝিনি, ভাবভঙ্গি দেখে বুঝলাম কোন রাস্তার ঠিকানা জানতে চাইছে। আমি হেসে ইংরেজিতে বলতে অনুরোধ করলাম। ভদ্রলোক এবারে সংকোচে প্রায় মাটির সাথে মিশে গেলো, বারবার স্যরি বলতে বলতে বললো, ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি নেপাল থেকে এসেছো!’
আমি ভাবলাম যা বাবা! এটাই তবে বাকি ছিল? আফ্রিকা, চীন, জাপান আর মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে টুরে আমরা অবশেষে একদম নেপালি পরিবার হয়ে গেলাম!

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-