'বই'কালিক গাল-গল্পঃ ২

অপু ভাই’র কথা বলছিলাম, যে কারণে ওনাকে আমার প্রকাশক হিসেবে চাইছিলাম না সেই কারণটা একদম সোজাসাপ্টা, তা হলো- ঊনি মানুষ বেজায় ভাল!
আরে, জানি রে ভাই জানি, আপনারা বলবেন এই তো আগের লেখাতেই না বললাম অপু ভাই লুক খ্রাপ? হু, তা বলেছি, তো একজন লুক খ্রাপ হলেই যে ভাল মানুষ হবে না এইটা কোন কথা হলো? দুনিয়া থেকে কি ইনসাফ উঠে গেছে? নাহ, উঠে নাই।
তো, এই ভাল মানুষ অপু ভাই’র সাথে সম্পর্কটা আমার ঠিক লেখক-প্রকাশকসুলভ নয়, অর্থ্যাৎ কি না, পেশাদারিত্বের লেশমাত্র নেই। আমার ঠিক এ ব্যাপারটাতেই ঘোর আপত্তি ছিল।
amarboi

প্রথম বই নিয়ে লোকের মনে নানা রকম পরিকল্পনা থাকে, সাধারণত। আমারও খানিকটা ছিলো। এবং নিজের স্বভাব যেহেতু জানি, এটাও জানতাম যে বইয়ের নানা বিষয় নিয়ে সেই পরিকল্পনার সাথে না মিললে আমি খুঁত খুঁত করবো অবশ্যই। এবং এ জিনিসটা সাবলীলভাবে করা যাবে যদি প্রকাশকের সাথে ধুমধাম আলাপ চালাতে পারি। আমার মনে হচ্ছিলো, অপু ভাই’র সাথে এই সব নিয়ে ক্যাঁচাল করতে গেলে দেখা যাবে আমাদের মধ্যের সুন্দর সম্পর্কের তেরোটা বেজে গেছে!
একটা ব্যাপার বুঝে গিয়েছিলাম, বই বের করতে হলে নিজের খরচেই করতে হবে। প্রকাশক এসে আমার লেখা পড়ে খুশি হয়ে বই বের করে ফেলবে, তারপরে মেলার কদিন যেতেই নতুন বউয়ের লজ্জামাখাভঙ্গিতে রয়্যালটির টাকার চেক দিয়ে যাবে পকেটে- এসব আজকাল বাংলা সিনেমার নায়কেও স্বপ্নে দেখে না, বাস্তবে তো অসম্ভব।
বই করার টাকা অবশ্য আমার জোগাড় হয়ে গিয়েছিলো, আমার বউ দয়াপরবশ হয়ে প্রথম বইয়ের খরচ আমাকে দান করবে বলে ঘোষনা দিয়েছিলো। কিন্তু অপু ভাই শুনেছি টাকা পয়সা নিয়ে কাছের লোকেদের সাথে ভালই ঘাপলা করেন। তবে দুনিয়া যেদিকে চলে ঠিক তার উলটো, উনি সহজে টাকা নিতে চান না। ওনার এই রেকর্ডের কারণেও আমি সংকোচে ছিলাম। বই বের হলেই যে হু হু করে বিক্রি হয়ে সব টাকা উঠে আসবে, নিজের ওপর এত ভরসা করবো এরকম বোকা আমি নই। খরচ যে-ই দিক, এটা পুরোই লস প্রজেক্ট। তাই আমার বই বের করে অপু ভাই শুধু শুধু আর্থিক সমস্যায় পড়বে এরকম সম্ভাবনাও আমার পছন্দ হচ্ছিলো না।
তারচেয়ে বড় কথা, নিজের খরচেই যদি করি, তাহলে কেন মনের খুশি মতন বই নিয়ে প্রকাশকের সাথে হাউকাউ করতে পারবো না?
সুতরাং, ঠিক করলাম, অপু ভাই নিপাত যাক।
আমি প্রকাশক খুঁজতে লাগলাম।
আমার অনেক বন্ধুই এখনও বিয়ে করেনি, তাদের কেউ কেউ আমাকে দেখে ঈর্ষা বোধ করে, বিশেষ করে যারা প্রেম ট্রেম করেনি, এখন উপযুক্ত পাত্র বা পাত্রীর সন্ধানে পাখী ভাইয়ের খাঁচায় দিবারাত্রি ‘কেম্নে আসে যায়’। মাঝে মাঝেই দেশে ফোন করে আমি আয়েশ করে তাদের ‘দুঃখে’র আলাপ শুনি, আর মনে মনে ভাবি, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি, আমাকে এই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি।
কিন্তু, এই যন্ত্রণার খানিকটা টের পেলাম প্রকাশক খুঁজতে গিয়ে। ‘উপযুক্ত’ প্রকাশক পাওয়া উপযুক্ত পাত্রী পাওয়ার চেয়ে কম যাতণার নয়।
একজন শুভাকাঙ্ক্ষী দেশের এক নামকরা প্রকাশনীর সাথে কথা বললেন। খুব দ্রুতই অবশ্য ওরা জানালো, নতুন লেখকদের বই করতে অনেকই আগ্রহী তারা, কিন্তু আপাতত সেখানে তিন বছরের একটা কিউ আছে। মানে, এবারে পান্ডুলিপি জমা দিলে বছর তিনেক বাদে তারা বই করলেও করতে পারেন।
সম্ভাব্যতার সূত্র মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে আমি ভার্চুয়াল পান্ডুলিপি ঝোলায় নিয়ে ভার্চুয়ালিই প্রকাশকদের দুয়ারে দুয়ারে হাঁটতে লাগলাম।
অবশেষে, একজন তরুণ প্রকাশকের নাম শোনা গেল, তাঁর প্রকাশনীটাও তুলনামূলক নতুন, গত কবছরের রেকর্ডও বলে, উনি আসলেই নতুনদের লেখা ছাপান। আমি আশায় খেলাঘর বাঁধলাম। ওনার মেইল এড্রেস জোগাড় করে ইমেইল পাঠালাম। কিন্তু দিন যায়, যায়, উত্তর আর মেলে না।
পত্রিকার সম্পাদকেরা শুনেছি খানিকটা গালভারি হন। সহজে চিঠির উত্তর দিতে চান না, তাহলে সম্পাদকসুলভ ভারিক্কি ভাবটা ঠিকঠাক বজায় থাকে না।
প্রকাশকদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম খাটে কি না জানি না, আগের অভিজ্ঞতা নেই একেবারেই, তাই করণীয় কী বুঝতে পারছিলাম না।
আমার বিপদ দেখে এবারে এগিয়ে এলেন আমার আরেক শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি কেমন করে কোন কোন ভায়া হয়ে যেন প্রকাশকের দপ্তরে খবর পাঠালেন, জনৈক লেখক-তকমা প্রত্যাশী তরুণ আপনাকে একটা ই-মেইল পাঠিয়েছেন, ওটা কি আপনি একটু পড়ে দেখবেন?
না, সাড়া নেই।
এদিকে বই মেলা এগিয়ে আসছে। আমি মাঝে একবার ভাবলাম, এবার তাহলে বাতিলই করে দেই, দরকার নেই এসবের। হলে পরে কোনদিন আপনা থেকেই হবে।
এর মাঝে অপু ভাই আরেকবার জিমেইলে আবার টোকা দিলেন, ‘পান্ডুলিপি কই?’
আমি তখন গভীর সংকটে। বুঝছিলাম আমার বই করা নিয়ে দুনিয়ার কারও যদি কোন আন্তরিকতা থাকে, তাহলে আছে কেবল এই নজমুল আলবাব অপুর। আর কারো নেই।
আমি তখন অপু ভাইকে লম্বা মেইল লিখলাম, বললাম, আপনারেই দিবো আমার বইটা, কিন্তু শর্ত আছে। বই নিয়ে আমার মতামতই চূড়ান্ত হতে হবে, যা কিছু নিয়া যা খুশি আপত্তি আমি করি, আপনাকে শুনতে হবে। অন্তত বই করাকালীন সময়ে আপনার আমার পেশাদার সম্পর্ক। আর, বই করার খরচও আমিই দিবো, এই নিয়েও গড়িমসি করা যাবে না।
অপু ভাই রাজি হলেন, আমিও মেইলের মধ্যে তার দস্তখত নিয়ে নিলাম।
তারপর আর কি, আমার পাপীষ্ঠ প্রকাশক হিসেবে নজমুল আলবাবই চূড়ান্ত হলেন!
তবে তিনি যে কী ভুলটা করলেন, সেটা তখনো বুঝতে পারেননি। (মু হা হা হা হা)
বইএর নাম নিয়ে বেশ খানিক চিন্তা ভাবনা করলাম। আমার কোন গল্পের নামই খুব আহামরি কিছু নয়। অন্তত এখনকার যুগের চটকদার নামগুলোর মত তো নয়ই। ‘রবিউল এবং একটি ফাউন্টেন পেন”, অথবা “পানিপথের যুদ্ধ কিংবা নানচাকুর সংলাপ”- এরকম আধুনিক কোন নামও আমার কোন গল্পেরই নেই। একদম সাদামাটা সব নাম, সমান্তরাল, শব্দশিল্পী, নিমন্ত্রণ, ইঁদুর। এসবের মধ্যে কাঠের সেনাপতি নামটাই খানিকটা ইয়ে আর কী। তো, মনে হলো, এটাকেই বইয়ের নাম হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়।
নাম ঠিক করার পর অপু ভাই বললো, এবার তো প্রচ্ছদ করতে হয়।
যথারীতি, প্রচ্ছদ বিষয়েও আমি অপু ভাইকে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে দিলাম। হেন করা যাবে না, তেন করা যাবে না।
অপু ভাই অনেক ধৈর্য্যশীল মানুষ। আমার সব কথা মন দিয়ে শুনলেন। বললেন, ঠিকই আছে, আমার কথামতনই প্রচ্ছদ হবে। তারপর বেশ কয়েকদিন লাগিয়ে তার বিশেষ প্রচ্ছদশিল্পীকে দিয়ে একটা প্রচ্ছদ করালেন। আমাকে মেইল করে এসএমএস করলেন, প্রচ্ছদ রেডি।
আমি শুনে তাড়াতাড়ি মেইল খুলে বসলাম।
প্রচ্ছদ দেখে কোন কথা না বলে আমি আমার শর্তলিপি থেকে প্রাপ্ত ক্ষমতার পুরোটাই তাৎক্ষণিক খাটালাম।
ফিরতি মেইলে অপু ভাইকে জানিয়ে দিলাম, বাদ দ্যান, এই প্রচ্ছদ চলবে না, এইটা কিছুই হয় নাই। ভুয়া!
ইন্টারনেটের অপর প্রান্তে বসে কেউ কি নিজের ভুল বুঝতে পেরে মাথায় হাত দিলো?
কে জানে! হাসি
( চলবে )

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-