গগণ আজ দেশে ফিরছে

১/
প্রায় বছর ছয় আগের কথা।
আমি তখন ডারবানে, গোবেচারা বৈদেশি ছাত্র হিসেবে প্রথম ভিনদেশে প্রবাসী। সেসময় আমার একটা কম্পিউটার কিনবার দরকার হলো।
ডারবানের কিছুই চিনি না আমি, সুপারস্টোর বা ইলেক্ট্রিক্যাল স্টোর কোনটা কী বা কেমন সেসব নিয়ে কোন ধারণাই নেই। আরও মুশকিল হলো, ডারবান শহরের রাস্তায় একা একা চলাফেরা করাও নিরাপদ নয়। তবু এর মধ্যেই বেশ কয়েকবার নিজে নিজে কম্প্যুর দোকান খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে বিফল হলাম। অতঃপর সেখানকার সদ্য পরিচিত বাঙালীদের এ সমস্যার কথা জানাতেই তারা ব্যাপক সাহায্য করলেন। অতি দ্রুত আমার জন্যে একটা কম্পিউটার কিনে ফেললেন, এবং সেটা বয়ে নিয়ে এসে আমার হোস্টেলের রুমে সেট করে দিয়ে গেলেন। আমি তো মহা খুশি!

কিন্তু দুদিন পরেই বাঁধলো গোলযোগ। কম্প্যু মহাশয় বিগড়ে গেলো, নট নড়ন নট চড়ন। আমি তখন ডাক পাঠালাম, কেমন করে এটা ঠিক করা যায়। সেই বাঙালী বন্ধুরা এসে এবার কম্প্যু সহ আমাকে নিয়ে শহরে চললেন বিক্রেতার কাছে। সেই দোকানে গিয়ে আমার কলম্বাসের মত অনুভুতি হলো, আমি আবিষ্কার করলাম বিক্রেতা একজন পাকিস্তানী!

আমার ব্যাপক মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কম্পিউটার ঠিক করিয়ে হোস্টেলে ফিরে আসলাম। কিন্তু তাতেও শান্তি নেই। কোন এক আজব কারণে আমার তরতাজা যুবক কম্প্যুটা বুড়ো মানুষের মত ধুঁকে ধুঁকে চলতে লাগলো। দুদিন পরপরই সিপিইউ নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করতে হয়। ঐ বিক্রেতার কাছে নিয়ে যাওয়াটাও একটা যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ালো অবশেষে। মাঝে একদিন আমার সাথে উর্দুতে ‘বাত চিৎ’ করার চেষ্টা চালানোয় তাকে ব্যাপক ঝাড়ি দিলাম। ঝাড়ি খেয়ে ব্যাটা খানিকটা রুষ্ট হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ তোমরা বাংলাদেশিরা মনে হয় পাকিস্তানীদের তেমন পছন্দ করো না, তাই না?’ আমি ততোধিক বিরক্তির সাথে উত্তর দিলাম, ‘ঠিক বলেছো, একদমই পছন্দ করি না, বিশেষ করে তখন যখন তোমরা উর্দুতে কথা বলতে আসো’!
কথাটা তার তেমন হজম হলো না। আমার কম্প্যু-সংক্রান্ত সকল দায় দায়িত্ব সে আর নিবে না বলে ঘোষণা দিলো, আমিও চোটপাট করে বগলে সিপিইউ চাপিয়ে বের হয়ে এলাম!
পরবর্তী ঘটনা সংক্ষিপ্ত। হোস্টেলে ফিরে গুগল কাকুর শরণাপন্ন হলাম। সার্চ করে করে হার্ডওয়্যার আর সফটওয়্যারের সকল জ্ঞান নিয়ে ফেললাম। র‍্যাম প্রসেসর আর হার্ড ডিস্ক, এবং যখন তখন অপারেটিং সিস্টেম বদলে ফেলা একসময় ডাল ভাত হয়ে গেলো, দেখলাম কম্প্যুও বেশ ভালই চলছে, তখন বুঝলাম আমি বেশ চলেবল একটা কম্প্যু-হাতুড়ে-ডাক্তার হয়ে গেছি!
সেই পাকিস্তানীর সাথে আর কখনো দেখা হয়নি। সেদিন মুখের উপর কথা শুনিয়ে দিয়ে বেশ শান্তি লেগেছিলো। যদিও ওই এলাকাটাই ছিলো পাকিস্তানীদের ডেরা, তবু সুস্থ শরীরেই সেখান থেকে ফিরে এসেছিলাম। 
কিন্তু সবার ভাগ্য একরকম নয়। যেমন আলাদা ছিলো গগণের ভাগ্য। গগণের কথা কি মনে আছে?

২/
মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের একটা নিবন্ধ সংকলন আছে, সেটারই একটা লেখা হিসেবে পড়েছিলাম গগণের কথা। বইটার নাম সম্ভবত প্রিয় গগণ ও অন্যান্য। সেখানে খুব বেশি কোন তথ্য ছিলো না। শুধু জানতে পেরেছিলাম গগণ নামে বাংলাদেশি এক যুবক বেলজিয়ামের মাটিতে নিহত হয়েছিলো। তাঁকে খুন করেছিলো দুই পাকিস্তানী নাগরিক। সেই পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ নিয়ে অপমানজনক কথা বলছিলো, তারই প্রতিবাদ করায় প্রাণ দিতে হয়েছিলো গগণকে।
সেই লেখাটি পড়ে বুকের গভীরে খুব বেদনা অনুভব করেছিলাম। ভিনদেশে একলা এক দেশপ্রেমিক যুবকের কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলাম, শোকার্ত ও একই সাথে ভীষণ আক্রোশে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।

এই সবগুলো অনুভুতিই ক’দিন আগে আবার ফিরে এলো মনে, একদম হুট করেই, মেলবোর্নের মাটিতে বসে।

৩/
গগণকে নিয়ে একটা নাটক হয়েছে শুনেছিলাম। সেটাই দেখার সৌভাগ্য হলো কিছুদিন আগে। নাটকের নামটা চমৎকার, “গগণ আজ দেশে ফিরছে”। বানানো হয়েছে বেশ অনেকদিন আগে। নির্মাণ শৈলীর কথা চিন্তা করলে এটিকে খুব যে উচ্চমানের নাটক বলা যায় তা নয়। একেবারে ছক কাঁটা পরপর সংলাপ, অভিনয়শিল্পীদের কারও কারও আড়ষ্টতা, কারও কারও অতি-অভিনয়, অথবা সম্পাদনার আরও কিছু দুর্বলতা, কিন্তু এ সব কিছু ছাপিয়ে পুরো নাটকটিতেই নির্মাতাদের ভালোবাসা জ্বলজ্বল করছিলো সারাক্ষণ।

GOGON AJ DESHE FIRCHE from Abu Shahed Emon on Vimeo.


দু;খজনক হলেও সত্যি যে এরকম গল্প নিয়ে নাটক করার কথা সব নির্মাতারা ভাবে না, সবাই দেশকে নিয়েও এভাবে ভাবে না, দেশের প্রতি ভালবাসার কথা এভাবে তুলে আনার চিন্তাও সবসময় সবাই করে না।
এই প্রবাসে একটা ছোট্ট ঘরে বসে আমরা সবাই এই নাটকটি দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। নাটক শেষ হবার আগেই আমার ছায়াসঙ্গিনী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, আমি একটা নোনতা ঢোঁক গিলে ফেললাম অতর্কিতেই। এরকম একটি গল্প নিয়ে নাটক বানাবার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানালাম পাশে বসে থাকা আবু শাহেদ  ইমন-কে, যে কিনা এই নাটকটির পরিচালক।

৪/
ভার্সিটিতে ঢোকার অল্প কিছুদিন পরেই অবধারিত ভাবে আমার দ্বিতীয় নিবাস হয়ে উঠলো টিএসসি। সেখানেই সারাদিন আড্ডা পেটাই, দুনিয়া ভেঙে ওলট পালট করি।
আমি তখন অল্প অল্প লিখতে পারি এবং অল্প অল্প আঁকতে পারি। এই অল্প-র উপর পুঁজি করেই বামনের চাঁদ ছোয়ার স্বপ্ন দেখতাম। মনে মনে গুরু মানতাম সত্যজিৎ রায়কে। তো দুরু দুরু বুকে গুরুর চলা পথেই এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢুকে গেলাম ফিল্ম সোসাইটিতে।
সেখানেই পরিচয় হয়েছিল এক ব্যাচ জুনিয়র ইমনের সাথে। যে সময়ের কথা লিখছি সে সময় আমাদের সবারই রক্ত গরমের সময়। এর সাথে ইমনের আরও একটা জিনিসও ছিলো, সেটা হলো ‘গরম মাথা’। কিছু হলেই হাউ কাউ বা ধুম ধামে ইমনের জুড়ি নেই। সে সময়কার ইমনকে দেখে ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে যা যা ভাবতাম, তার কোন গলি ঘুঁপচিতেও ‘পরিচালক’ শব্দটা ছিলো না বলেই আমার সন্দেহ হয়।

ফিল্ম সোসাইটিতে কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রবল আশাভঙ্গ হলো। ফিল্ম নিয়েই সংগঠন যদিও, কিন্তু যখন টের পেলাম ওখানে ফিল্মের চেয়েও সংগঠনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ- আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে সরে আসা শুরু করলাম। মাঝে একবার শুনলাম, টিএসসিতে বসে মাথা দুলিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে জোরে জোরে চন্দ্রবিন্দু বা মহীনের ঘোড়াগুলি গাওয়া ইমন নাকি সিঙ্গাপুরে গিয়েছে পড়তে, তারপর আবার ফিরেও এসেছে সেখান থেকে। এর কিছুদিন পর আমি নিজেই দেশ ছাড়া হয়ে গেলাম।

তারপর দীর্ঘদিনের বাদে গতবছর আবার ইমনের সাথে দেখা মেলবোর্নে। দেখি অনেক বদলে গেছে ইমন। আগের সেই মাথা গরম ভাবটি একদম হাওয়া। অনেক বেশি ঠান্ডা মেজাজ, অনেক বেশি গোছানো, অনেক বেশি ফোকাসড। সিঙ্গাপুরের পরে ইমন ছ’মাসের জন্যে ইউএসএতেও গিয়েছিলো বৃত্তি নিয়ে। তারপরে দেশে ফিরেছে, অনেকগুলো নাটক আর ফিল্মে কাজ করতে করতে শিখেছে অনেক কিছু। এখানে সিডনি ফিল্ম স্কুলে এসে পড়েছে অজি সরকারের দেয়া বৃত্তিতে, সেখান থেকে আবারও বৃত্তি পেয়ে এসেছে RMIT মেলবোর্নে, ফিল্ম নিয়েই পড়বে বলে।
গত একবছর খুব কাছ থেকে দেখেছি ইমন-তন্বী দম্পতিকে। একদম যোগ্য জীবনসঙ্গিনী পেয়েছে ইমন। খুবই প্রাণবন্ত আর পরিশ্রমী মেয়ে তন্বী। নিজের পড়াশোনা বা চাকরির বাইরেও ইমনকে সাহায্য করে সবদিক দিয়ে, মোটামুটি দুই ডানা দিয়ে আগলে রাখে ইমনকে।
আমার দেখে খুব ভাল লাগলো, ইমনের চিন্তা ও চেতনায় এখন কেবলি ফিল্ম। যখনি আলাপ করি আমরা, যা নিয়েই হোক, সেই ‘গরু নদীতে ফেলার’ মত করে সেটা কেমন করে যেন ফিল্মে গিয়ে ঠেকে। কেমন করে একটা ভাল ছবি বানানো যায়, কবে কী ভাল ছবি দেখলো, দেশের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তি কদিন বাদেই, সেটা নিয়ে কী চমৎকার একটা ফিল্ম হতে পারে! এইসব ভেবেই দিন কাটে ওর। সারাক্ষণই কত কত পরিকল্পনা, এবং মজা হলো এই উদ্দীপনা কেবল নিজের জন্যেই নয়, চারিদিকে ছড়িয়ে দিতেও ওস্তাদ সে। আমি যেন একটা চমৎকার স্ক্রিপ্ট লিখে দিই ওকে, অথবা একটা সুন্দর গল্প অথবা একটা প্লট। তিথি যেন মিউজিক নিয়ে আরেকটু কাজ শিখে, অথবা যেন কণ্ঠ দেয় ওর ছবিতে, এসব নিয়ে সারাক্ষণই কত পরিকল্পনা।

আমাদের বাসাটায় টিএসসি বা কার্জন হল মাঠের একটা টুকরো যেন উঠে এসেছিলো গত একটা বছর। বহুদিনের বাদে আমরা সেই স্বপ্নীল দিনগুলোয় ডুবোডুবি করছিলাম।

এখানে এসেও ইমন বারবারই প্রমাণ করছিলো যে ফিল্মটা আসলে ওকে দিয়েই হবে। এখানে পড়তে পড়তেই কোরিয়ার বুশান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যোগ দেয়ার জন্যে আবেদন করলো, দেখি সুযোগও পেয়ে গেল। সতের দিনের জন্যে সেখানে গিয়ে বাংলাদেশি তরুণ পরিচালকদের সম্পর্কে ধারণা অনেক উঁচুতে নিয়ে গেল ও, ফিরে এলো পঁচিশ হাজার ডলার সমমূল্যের পুরস্কার নিয়ে।

অস্ট্রেলিয়ায় ইমনের পড়াশোনার দুবছর পূর্ণ হলো গত ডিসেম্বরে। পড়াশোনা যেহেতু শেষ, ইমন আর তন্বী ঠিক করেছে ওরা দেশে ফিরে যাবে, দেশে গিয়ে অনেক পরিকল্পনা, অনেক কাজ করার আছে ওদের।

আমি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নই, তাই ইমন একদিন বিরাট পরিচালক হবে, এরকম কথা হয়তো নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। কিন্তু আমি জানি যে সব ভালোবাসারই একটা প্রতিদান আছে, তাতে কখনোই ভুল হয় না। ফিল্ম নিয়ে ওর এবং দেশ নিয়ে ওদের দুজনের যে ভালবাসা, সেটা একদিন ওদেরকে অনেক দূর নিয়ে যাবে, সেই আশা করতেই পারি।

৫/
মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের দেশটা আসলে খুব সৌভাগ্যবতী, পুরো পৃথিবী জুড়ে গগণের মত লক্ষ-কোটি সন্তান ছড়িয়ে আছে তাঁর, যারা তাঁকে মায়ের মতই ভালোবাসে, উঠতে বসতে সারাক্ষণই তাঁর মঙ্গলের কথা ভাবে। সুদুর প্রবাসে বসে তারা দেশের কথা ভেবে আবেগের কান্না লুকোয়।

কিন্তু সবাই সৌভাগ্যবান নয়, সেই ভালবাসাটার বহিঃপ্রকাশ সবার ভাগ্যে লেখা থাকে না। অনেকে সুযোগ পায় না, অনেকের সুযোগ হয় না, অনেকে চাইলেও দেশের কাছে ফিরে যেতে পারে না সহসাই।
ইমন সেদিক দিয়ে অনেক অনেক ভাগ্যবান। একগাদা স্বপ্ন চোখে দিয়ে, অনেক ভালোবাসা বুকে নিয়ে আজ রাতের প্লেনেই দেশের জন্যে যাত্রা করবে ওরা। অনেক গগণের প্রতিনিধি হয়ে আজ অন্তত একজন গগণ দেশে ফিরবে।
তাঁর জন্যে রইলো শুভকামনা।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-