হাওয়াই মিঠাই ১৬: বাংলা লাইব্রেরী
একদম নীচের তাক থেকে বনফুলের রচনাসমগ্রের সবগুলো বই একেবারে লাস্যময়ী তরুণীর মত হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে। আমি বেশ দ্বিধায় পড়লাম। একসাথে সব কটাকে পাওয়া বেশ দুষ্কর, দেখা যায়, কোনটা না কোনটা আগেই কেউ ইস্যু করে নিয়ে যায়, আমি অন্য কোন একটা নিয়ে যাই ঠিকই, কিন্তু বনফুল একবারে সব পড়ে ফেলবো, বহুদিনের এরকম একটা ইচ্ছেকে কোনভাবেই পূরণ করা হচ্ছে না। এবারে একদম মোক্ষম সুযোগ চলে এসেছে যাকে বলে, কিন্তু এবারে আসার সময় অন্য লেখকের চিন্তা মাথায় ছিলো, বনফুল নিয়ে যাবো সেরকমটা ভাবিনি। তাই, সে তরুণীদের ডাক উপেক্ষা করবো বলেই ঠিক করলাম।
মাউন্ট ওয়েভারলির এই বাংলা লাইব্রেরির খোঁজ আমাকে দিয়েছিলেন সুচেতাদি। প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা সেটা। দেশ ছেড়েছি তারও বছর ঘুরে গিয়েছিলো তখন, সাথে করে নিয়ে আসা আমার কাছে বই মোটে তিনটে। জীবন বাবুর কবিতাসমগ্র, সত্যজিতের গল্প ১০১ আর শীর্ষেন্দুর পারাপার। তিনটা বইই আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে যাবার জোগাড়, বাংলা হরফ চেখে দেখার জন্যে অনলাইনে ঘুরে বেড়াই পাগলের মতন, সেই প্রবল জরুরি সময়ে এই লাইব্রেরিতে এসে আমি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম! অন্য অনেকগুলো ভাষার সাথে বাংলার জন্যেও তিন চারটে বড় বড় শেলফ বরাদ্দ করে রাখা, অভিবাসীদের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যের সার্ভিস। একটা ড্রাইভারস লাইসেন্স দেখিয়ে মেম্বার হওয়া যায়, তারপরে মেরেকেটে তিনমাসের জন্যে তিরিশ খানা বই নিয়ে হাপিশ হয়ে যাও, যেটাকে যেমন ইচ্ছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ো, কোনটাকে বারবার পড়ো, কোনটাকে নাইবা পড়ো। এরকম আনন্দ বৈদেশে এসে পাবো তা ভাবিনি।
লোটা-কম্বল খুঁজছি অনেকদিন ধরে। কলেজে থাকাকালীন অল্প বিস্তর পড়েছিলাম, আবারও পড়ার ইচ্ছে হচ্ছিলো, কিন্তু পেলাম না কোথাও খুঁজে। বইটা আদতে এই লাইব্রেরিতে আছে কি না সেটাও জানার উপায় নেই। কারণ লাইব্রেরিয়ান বাংলা জানে না। লাইব্রেরির ডাটাবেইজে সার্চ করা যায় অবশ্য, আমি দুয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কাজ হয়নি। কোন এক বিচিত্রি কারণে এই লাইব্রেরির বাংলা বইগুলোর নিবন্ধন হয়েছে অদ্ভুত ইংরেজিতে। সহজবোধ্য ইংরেজির বদলে কিছু ব্যাতিক্রম ঘটানো হয়েছে, অ- এর জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে a, সেই হিসেবে আ-কারের জন্যে ডাবল a, এটুকু ঠিক আছে, কিন্তু মুশকিল হয়েছে, বর্ণের শেষে যে লুকোনো অ- থাকে, সেটার জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে মাথার উপরে টুপিওয়ালা একটা a। এবং এখানেই গন্ডগোল লেগে গেছে, সার্চ করার সময় ইংরেজি হরফে বাংলা নাম টাইপ করলে অনেক হিজিবিজি দেখায়, বেশির ভাগ শব্দই ভরা থাকে অদ্ভুত সব হরফে, যেমন @#& এরকম!
আনিসুল হকের ‘জিম্মি’ আছে দেখি। প্রচ্ছদে আবার সিনেমার কলাকুশলীদের ছবি, নিচে বড় করে জানিয়ে দেয়া যে এই গল্প অবলম্বনেই তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। বেশ মজা পেলাম দেখে। প্রকাশকরা স্মার্ট হচ্ছেন, দেখে ভাল লাগলো। স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ব্যাপক হিট হবার পরে বইয়ের দোকানে গিয়ে দেখি মূল বইয়ের প্রচ্ছদ বদলে সিনেমার পোস্টার দিয়ে বইয়ের কাভার বানিয়ে দেয়া হয়েছে, বইয়ের নামও পূর্বতন নাম Q &A বদলে স্লামডগ মিল্যনিয়ার করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য নিচে, ওখানেও, ছোট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, এই বর্তমান স্লামডগ সাহেবই প্রাক্তন কিউ আন্ড এ।
প্রথম যখন এ লাইব্রেরীর সদস্য হই, তখনো খুব বেশি বাংলাদেশি লেখকদের বই ছিলো না এখানে। অল্প কিছু হুমায়ুন আহমেদ, তসলিমা নাসরিন আর জাফর ইকবালের বই ছিল, সাথে আরো দুয়েকজন সুপরিচিতের বই। ব্যাপারটা খুব চোখে লাগে তখন। আমি অত্যুৎসাহী হয়ে লাইব্রেরিরি ঠিকানায় ইমেইল পাঠিয়েছিলাম, বলেছিলাম বাংলাদেশি বইয়ের স্বল্পতার কথা, এবং বলেছিলাম, বাংলাদেশি বই সংগ্রহের কোন ইচ্ছা যদি এনাদের থাকে, তাহলে আমি স্বতস্ফূর্তভাবে সাহায্য করবো।
পাঁচ বছর বাদেও সেই মেইলের উত্তর পাইনি। এখানে এরকমটা হয় না সাধারণত, মেইল করলে প্রত্যুত্তরে একটা ভদ্রতাসূচক মেইল অন্তত পাওয়া যায়। পরে যখন শুনেছি, বাংলা সেকশানের দেখাশোনার ভার আসলে বাংলাভাষীরাই করে থাকেন, তখন আর অবাক হইনি।
অবশ্য মেইলের উত্তর না পেলেও কয়েক মাস পরে লাইব্রেরিতে গিয়ে বেশ বুঝতে পারি, আমার মেইলটা হয়তো জায়গামতনই পৌঁছেছিলো। কারণ, হুমায়ুন আহমেদ আর জাফর ইকবালের সাথে শেলফকে ধন্য করে দেখলাম বসে আছেন আনিসুল হক! মানে, একেবারে ঠিকঠাক বাজার বুঝেই বই আনানো হয়েছে।
এখন অবশ্য আরও অনেকেই যুক্ত হয়েছেন সেই তালিকায়, ইলিয়াস এবং সৈয়দ হকের আরও অনেক বই এসেছে। সব মিলিয়ে এখনকার চেহারাটাকে অনেক পরিপূর্ণই বলা চলে।
সৈয়দ মুজতবা আলী সমগ্রের একটা খন্ড বগলদাবা করে ফেললাম। সাথে সৈয়দ হকেরও একটা।
কিছু আনকোরা নাম-না-জানা বুদ্ধদেব গুহর বই গড়াগড়ি খাচ্ছে। কদিন আগে এনার একটা বই পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিশোর বয়সে ওনার বেশ কিছু বই খুব ভাল লেগেছিলো, মাঝে অনেকদিন পড়া হয়নি, সেদিন যে বইটা পড়বো বলে হাতে তুলে নিয়েছিলাম, তার নাম ‘সম’। পড়তে পড়তে হতাশ হতে হলো। জল-জঙ্গলের অনেক বেশি পুনরাবৃত্তি। অনেক আগে এক বড়ভাইয়ের কাছে বুদ্ধদেবের লেখা একটা চিঠি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তখনো কোন লেখকের নিজের হাতে লেখা চিঠি দেখিনি জীবনে। আমি অতি আগ্রহে সে চিঠি খুলে দেখি, নিয়মমাফিক কেমনাছোভালো-র পরে ঢাকায় বুদ্ধদেবের বইয়ের অনেকগুলো পরিবেশকের নাম দেয়া লিস্টি করে, সেই সাথে তাদের প্রকাশিত বই, এবং তলানিতে ছোট করে সেই সব বই কিনে পড়ার ছোট্ট অনুরোধ। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম এরকম অদ্ভুতুড়ে চিঠি দেখে। সেই বিস্ময়বোধ অনেকদিন বাদে আবারো ফিরে এলো, যখন দেখি, সম উপন্যাসের চরিত্ররা ঘুরে ফিরে মাধুকরীর পৃথু ঘোষের সংলাপের রেফারেন্স টানছে!! দুটি চরিত্র নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে কদিন আগেই পড়া ‘একটি.চমৎকার অন্যরকম উপন্যাস’ চাপরাশ নিয়ে!! রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর উদাহরণে বারে বারে ফিরে এলো ঋতু গুহের নাম। এবং এসবেরই ষোলকলা পূর্ণ হলো যখন দেখি, উপন্যাসের একটা চরিত্র আরেকটা চরিত্রকে উপদেশ দিচ্ছে কী করে কোলকাতা থেকে আনন্দ পাবলিশার্সের বই ভিপিপি যোগে দুর গঞ্জ গাঁয়ে বসে সংগ্রহ করা যায়! এরপরে বইটা আর পুরোটা পড়বার কষ্ট নিজেকে দিতে চাইনি। যদিও শহুরে মেয়ের প্রায় আদুল গায়ে জঙ্গলে স্নানের বর্ণনা আছে, আর মাত্র বছর বারো আগে হলেই এটা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ঠ ছিলো। কিন্তু এবারে বুঝলাম, বুড়ো হয়ে গেছি আমি, হয়েছেন বুদ্ধদেব গুহও। সেই সাথে তিনি হয়ে গেছেন অনেক বেশি বাণিজ্যিক।
বুদ্ধদেব গুহ আর পড়বো না বলে ঠিক করেছি।