হাওয়াই মিঠাই ১৫: অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচন

কদিন আগে এখানে একটা মজা হলো। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় জানতাম এখানকার প্রধানমন্ত্রীর নাম কেভিন রাড, সকালে উঠে শুনি, রাড নয়, এক রাতেই প্রধানমন্ত্রী পালটে গেছে, এখন প্রধানমন্ত্রী হলেন জুলিয়া গিলার্ড।
ব্যাপারটা হুট করে হজম হলো না যদিও, অনেকটা আমাদের উপমহাদেশীয় অঞ্চলের ক্যু-এর মত অবস্থা।
জুলিয়া গিলার্ড দু দিনের মাথাতেই ব্যাপক আলোচনায় চলে আসলেন। ভদ্রমহিলা, তার সময়ে, ব্যাপক সুন্দরী ছিলেন। গত বছর কোন একটা অনলাইন পোলে, অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে আবেদনময়ী (হলো না বোধহয়, ওয়ান আপ অন কজ সি-র সঠিক বাংলা কী হবে? ) রাজনীতিক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পত্রিকায় ছবি টবি দেখে কথাটা নির্বিবাদে মেনে নিলাম।
তারওপরে, মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবার সময়ে আরও তুলকালাম, সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন, তাই ঐ বায়বীয় ভদ্রলোকের নামে শপথও নিতে পারবেন না।
এখানকার লোকে কেউ কেউ খুশী হলো, কেউ ভুরু কুঁচকে তাকালো, আমি ব্যাপক আমোদ পেলাম।
জুলিয়া এসেই অনিল কাপুর স্টাইলে, মানে, নায়ক সিনেমায় একদিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়া অনিল কাপুরের কথা বলছি, জুলিয়া ঠিক তার মতই ধুমধাম সব সমস্যা ঠিক করতে উঠে পড়ে লেগে গেলেন। প্রথমে খনি শ্রমিকদের উপর চেপে বসা ট্যাক্স কমিয়ে দিলেন। মন্দ লোকে বলে, কেভিনের সরে যাবার পেছনে নাকি ওদেরই হাত আছে।
খানিকটা সুস্থির হয়ে কদিন আগে তিনি নির্বাচনেরও ঘোষণা দিলেন।
অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তিত নই অবশ্য। আগেও বলেছি, বেল গাছে আপাতত বাসা বেঁধেছি যদিও, তবু বেল পাকলে পরেও আমার পরিচয় কাক বৈ অন্য কিছু নয়।
তবু, আজ সকালে, পোস্ট বাক্স খুলে দেখি একটা চিঠি এসেছে। বর্তমান বিরোধী দলের মেলবোর্ন প্রার্থীর চিঠি। নির্বাচনী প্রচারণার অংশ এগুলো, গড় হারে সবার বাক্সে দিয়ে যায়।

আমি কী ভেবে চিঠিটা খুলে নিয়ে পড়লাম।
আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে আগে বেশ হাড্ডাহাড্ডি অবস্থা দাঁড়ায়। কেউ কারে নাহি ছাড়ে, বরং পারে তো ডিশুম ডিশুম মারে। এই ভদ্রলোকের চিঠি দেখলাম বেশ সভ্য-ভব্য। আমি ভাবলাম অনুবাদ করে ফেলি।
প্রথম লাইনটা এরকম, “ডিয়ার ভোটার, দিস ফেডারেল ইলেকশান ইজ ক্রুশাল ফর দ্য ফিউচার অব আওয়ার নেশান।”
তো, আমি অনুবাদ করলাম, “প্রিয় ভোটার, সামনের নির্বাচন আমাদের জাতির ভবিষ্যতের জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।”
এটুকু লিখেই মনে হলো, এক কাজ করলে কেমন হয়, বাংলাটা বদলে ফেলি। আমাদের দেশীয় নির্বাচনের আমেজে যদি এটার অনুবাদ করি!
তো শেষমেষ ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ালো।
“ আমার প্রাণপ্রিয় ভাই ও বোনেরা,
আসসালামুয়ালাইকুম। আপনারা জানেন, এবারের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন আমাদের এই অভাগা জাতির জন্যে এক মহা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। দুনিয়া জুড়া এই যে পচুর গিয়াঞ্জাম, আর অস্ট্রেলিয়ার মাথার উপরে এই যে একশ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা, এইসব নিয়া, আমরা আমাদের জীবনের এক ক্রান্তি লগ্নে আসিয়া দাঁড়াইছি।
গত তিন বছর ধরে ‘লেবার’ সরকারের একের পর এক ব্যর্থতার কারণে আমাদের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে, আমরা দুর্বল হয়ে গেছি। এমনকি এই সরকার নিজেরাও স্বীকার করে নিয়েছে যে তারা পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে।
ভাইসব, জিনিসপত্রের আকাশ ছোয়া দাম আর ব্যাংকের সুদের হার বাড়তে বাড়তে অনেক অস্ট্রেলিয়ান পরিবারকে এখন একেবারে খাদের কিনারে নিয়া গেছে এই সরকার। পাহাড়সমান ঋণের বোঝা, বাজেট ঘাটতি, ইশকুল আর বাড়িঘর উন্নয়ন প্রকল্পের জগাখিচুড়ি অবস্থা, এবং বহির্দেশ থেকে চোরাকারবারিরা একের পর এক আমাদের দুর্বল সীমান্ত দিয়া এ দেশে ঢুকে পড়তেছে। এই সরকার সেসবে ধ্যাণ না দিয়ে নতুন নতুন ট্যাক্স বসাইয়া আজকে চাকরি বাকরি আর পুঁজি বিনিয়োগকারীদের হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সেই সাথে একটা ভাঙা খাটের পায়ার মতন নড়বড়ে অর্থনীতি আমাদের জনজীবনে আজকে দুর্যোগের ঘনঘটা বয়ে এনেছে।
এখন আবার লেবার পার্টি তার ভেতরের ক্ষমতাসীনদের গোপন কলকাঠি নাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ান ভোটারদের অবজ্ঞা করে  মিনিটের মধ্যে একটা প্রধানমন্ত্রীকে হঠিয়ে দিয়ে আমাদেরকে আরও বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তারা ভেবেছে, প্রধানমন্ত্রী বদলাইয়া তারা আমাদেরকে ধোঁকা দিতে পারবে। ভেবেছে, নেতা বদলাইলেই স-অ-ব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ভাইসব, আমরা বোকা না, আমরা বুঝি। নেতা চলে গেলেও এইটা সেই একই সরকার, একই সমস্যা দিয়ে দিয়ে তারা আরও বেশি দুর্ভোগ নিয়ে আসতেছে।
ভাই ও বোনেরা আমার, চোখ মেলে বাস্তবতা দেখেন, দেখেন এই সরকার কেমন করে সারা জীবন শুধু মুখে বড় বড় বুলিই ফুটাইয়া গেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করে নাই।
কিন্তু, আমি, আজকে, এই আপনাদের সামনে দাঁড়াইয়া প্রতিজ্ঞা করতেছি, লিবারেল পার্টির একজন সদস্য হিসেবে আমি খালি কথায় চিড়া ভিজাবো না, কাজের মাধ্যমে আমি আমার কথার প্রমাণ দিবো।
আমাদের দলের কাজের ধারা দেখলেই আপনারা আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশদ জানিতে পারবেন। যার মধ্যে আছে, সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই দেশের অর্থনীতির পিঠ সোজা করা, লেবার পার্টির করা বিশাল ঋণের বোঝা কমাইয়া আনা, এই সরকার যত টাকা অপচয় করেছে সব কিছু থামিয়ে দিয়ে বাজেট ঘাটতি থেকে উদ্ধৃততে নিয়ে যাওয়া। অস্ট্রেলিয়ার সীমান্ত আরও দুর্ভেদ্য করে তুলবো আমরা, শিক্ষার মান বাড়ানো হবে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অবহেলা না করে তাদেরকে সহায়তা দেয়া হবে, যেন অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি আরও বলবান হয়ে ওঠে।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আজ এই শুভ লগ্নে, আমি আপনাদের কাছে হাত জোড় করে ভোট চাইতে এসেছি। কথা নয়, সত্যিকারের কাজ করার এখুনি সময়, অস্ট্রলিয়াকে সঠিক পথে চালনার এখনই সময়।
আপনাদের বিশ্বস্ত,
সাইমন ওলসেন। “
আমি যা বুঝলাম, সব দেশের রাজনীতিকরা আসলে ঘুরে ফিরে একই কথা বলে, কেউ ভুলভাল বাংলায়, আর কেউ শুদ্ধ ইংরেজিতে। 

21072010150

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-