অমিতাভ রেজার নাটক
বাংলাদেশি নাটকে পরিচালকের নাম দেখে নাটক বাছাই করার অভ্যেসের শুরু মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর কল্যাণে। কিন্তু সেই ঊষা লগ্ন এখন গত-প্রায়, এখনও তার নাটক দেখি, কেবল যদি পর্যাপ্ত সময় থাকে হাতে। তারপরেও কিছুটা একঘেয়েমিতে ভুগি, ফারুকীর নাটকের পাত্র-পাত্রীরা সবাইই কেন জানি খুব উচ্চ স্বরে কথা বলে। আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অবিরাম ঝগড়া করতে থাকে কেউ কেউ, এবং নাটকে মোবাইলের ব্যবহার দৃষ্টিকটু রকমের বেশি, বাংলাদেশে মোবাইলের প্রথম যুগের মত অনেকটা। যেন সবাইই গত পরশু মোবাইল ফোন কিনে গতকাল সারাদিন ব্যাটারি চার্জ দিয়ে আজ নাটকের শ্যুটিং করতে চলে এসেছে।
তারপরেও নাটক দেখার অভ্যাস এখনও পাকাপোক্ত আছে অল্প কজন পরিচালকের গুণে, তাঁদের একজন অমিতাভ রেজা।
সম্ভবত গত ঈদেই দেখেছিলাম [i]ইকুয়াল টু[/i]। ছিমছাম একটা নাটক, আরজে নওশীন ছিলো অভিনয়ে, নাটকেও আরজেরই ভুমিকা তার। গল্পটা চমৎকার, এবং দেখতে দেখতে বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্নালু সময়টায় ফিরে যাচ্ছিলাম।
অবশ্য, অমিতাভ রেজার ভক্ত হয়েছি তারও আগে, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্প অবলম্বনে বানানো নাটক '[i]একটা ফোন করা যাবে প্লিজ?[/i]' দেখার সময়। (অবশ্য ধন্যবাদ প্রাপ্য কমরেড ইউটিউব, তোমাকে লালসালাম।) :)
মার্কেজের মূল গল্পটা বহুবার পড়া। আমার খুবই 'অপ্রিয়' গল্প এটা। হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসগুলোর কিছু কিছু লাইন আছে এমন, পড়ার সময় মনের ওপর খুব চাপ পড়ে, হাসফাঁস লাগে, দম বন্ধ করা একটা অনুভুতি কাজ করতে থাকে মনে। মার্কেজের, বিশেষ করে এই গল্পটা তেমনি। যতক্ষণ পড়তে থাকি চারপাশের সবকিছুর ওপর অবিশ্বাস চলে আসে। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতায় হত বিহবল হয়ে পড়তে হয়। গল্পটা এরকম- রাতের অন্ধকারে পথ ভুল করে বসে একটা মেয়ে। বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে যে বাসে চড়ে বসে, সেটা ছিলো আসলে একটা মানসিক হাসপাতালের বাস। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটি, সকালে যখন উঠে, দেখতে পায়, হাসপাতালে নেমেছে সে, ডাক্তার ও নার্স পরিবেষ্টিত, এবং সবাই ভাবছে, সে-ও একজন মানসিক রোগী। মেয়েটা কোনভাবেই বিশ্বাস করাতে পারে না যে সে রোগী নয়, বারবার শুধু সে তার স্বামীকে ফোন করতে চায়, শুধুই আকুতি করে, একটা ফোন করা যাবে প্লিজ?
মার্কেজের মূল গল্পটা শেষ হয় বুকের ভেতরটা একদম দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে। গল্পে আছে, মেয়েটা ওই হাসপাতালেই থেকে যায় চিরকাল, ওর স্বামী বহুদিন পরে ওকে খুঁজে পায় সেখানে। কিন্তু কে জানে কার উপর অভিমানে সে আর ফিরে আসতে চায় না, ওখানেই থেকে যায় বাকি জীবন।
অমিতাভ রেজা গল্পটাকে নাটক বানানোর সময় আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপট দেখিয়েছেন। মেয়েটির ভূমিকায় ছিল সম্ভবত তাঁরই স্ত্রী, জেনি। ডাক্তার ছিলেন ইরেশ যাকের। প্রত্যেকের অভিনয়ই অনবদ্য ছিলো। প্রথমবার নাটকটি দেখার সময় মার্কেজের গল্প পড়ার সময়কার চাপটা টের পাচ্ছিলাম বেশ। নাটকের শেষটুকু দেখতে চাইছিলাম না একদম, জানিই তো কী হবে, আবারও মন খারাপে ডুবে যাবো। কিন্তু দেখি, অমিতাভ রেজা কাহিনি বদলেছেন ওখানে, নাটকের মেয়েটি শেষমেষ খুঁজে পায় ওর প্রেমিককে, এবং নাটকের শেষ পরিণতি হয় মিলনাত্মক।
আমি রীতিমত খুশি হয়ে গেছিলাম এই বদলে, মনে মনেই অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছি তাঁকে, মুগ্ধ হয়েছি তাঁর এডাপশানের মুন্সীয়ানায়।
*
গতকাল দেখলাম তাঁর বানানো এবারের ঈদের নাটক, [i]এ সময়[/i]।
নাটকের মূল গল্পটি নেয়া হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প 'মিলির হাতে স্টেনগান' থেকে। আশ্চর্য এ-ই যে, এ গল্পটিও আমার বহু বহুবার পড়া। আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পগুলোর একটি এটি। গল্প হিসেবে এটি অসম্ভব শক্তিশালী। কিছু কিছু গল্পের প্লট আছে, যেগুলো বেয়াড়া ঘোড়ার মতন, কেবলই তেড়ে ফুঁড়ে আসে, এগুলোকে লাগাম পড়ানো শক্ত কাজ। ইলিয়াস ছাড়া আর কেউ এই গল্পটি সামলাতে পারতেন কিনা, সে নিয়ে আমার ব্যাপক সন্দেহ।
তো, এই অসম্ভব প্রিয় গল্পের নাট্যরূপ দেখতে পাবো আরেকজন প্রিয় পরিচালকের হাতে, এই আশা নিয়েই নাটক দেখতে বসা।
নাটক খারাপ লাগেনি, নাটক হিসেবে এটি ভালই হয়েছে। কিন্তু গল্পটা জানা থাকায় খানিকটা হতাশ হয়েছি আমি।
গল্পটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ের। তরুণ যোদ্ধারা ফিরে এসে সবাই ঠিক পথে হাঁটেননি। কেউ কেউ বেছে নিয়েছিলেন অন্ধকার জগত, গল্পের মূলভাবটা সেরকমই। কিন্তু নাটকে, এটাকে একদম এই সময়ের গল্প বানিয়ে ফেলা হয়েছে। নাটকের অন্যতম মূল চরিত্র আব্বাস পাগলা। এই চরিত্রটি অবিকল ছিল অবশ্য, এবং বলা চলে গল্প আর নাটকের একমাত্র যোগসূত্রও ছিলো আব্বাস পাগলাই। গল্পে অন্ধাকার জগতের ব্যাপারটা ছিলো আবছায়ার মত, তার ফলাফল অবশ্য ছিল সামনেই। নাটকের প্রয়োজনেই হয়তো আবছায়াগুলোকে শরীর দেয়া হয়েছে, নতুন চরিত্র আনা হয়েছে অনেক, স্পষ্ট হয়েছে মিলির ভাই রানার কর্মকান্ড।
আমার অবশ্য মনে হয়েছে, এটার দরকার ছিলো না। এইটুকু স্পষ্টতা না দেখালেও চলতো। মূল গল্পকে অনুসরণ করে নাটকটা নির্মিত হলে আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠত সেটা।
মিলির হাতে স্টেনগান গল্পের আসল অংশ হচ্ছে এর শেষটুকু। যেখানে দেখায়, আব্বাস পাগলা ভাল হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু তাঁর কষ্টটুকু পাগলামি হয়ে ঢুকে পড়ে মিলির মাথায়, সে তখন ছাদের উপরে উঠে গিয়ে আকাশে উড়াল দেবার জন্যে পা ঝাপটায়।
আমার তীব্র আগ্রহ হচ্ছিলো, এটাকে চিত্রায়ন করা হয় কীভাবে তা দেখার। নাটকে ইলিয়াসের লেখার এই অনুভুতি নিয়ে আসা সহজ নয়। তো, [i]এ সময়[/i] নাটকটির শেষটুকু দেখেও আবারও খানিকটা হতাশই হতে হলো। ওরকম আবেদন আসেনি। নাটকটা হয়ে গেছে বিপথগামী কোন যুবকের বোনের গল্প, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের টানাপোড়া সেখানে অনুপস্থিত।
আগের বার খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু এইবার, এই বদলে মন খারাপ হলো।
জানি সম্ভব নয়, তবু যদি পারতাম, আমি অমিতাভ রেজাকেই অনুরোধ করতাম নাটকটা আরেকবার বানাতে, আর কাউকে নয়।
তারপরেও নাটক দেখার অভ্যাস এখনও পাকাপোক্ত আছে অল্প কজন পরিচালকের গুণে, তাঁদের একজন অমিতাভ রেজা।
সম্ভবত গত ঈদেই দেখেছিলাম [i]ইকুয়াল টু[/i]। ছিমছাম একটা নাটক, আরজে নওশীন ছিলো অভিনয়ে, নাটকেও আরজেরই ভুমিকা তার। গল্পটা চমৎকার, এবং দেখতে দেখতে বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্নালু সময়টায় ফিরে যাচ্ছিলাম।
অবশ্য, অমিতাভ রেজার ভক্ত হয়েছি তারও আগে, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্প অবলম্বনে বানানো নাটক '[i]একটা ফোন করা যাবে প্লিজ?[/i]' দেখার সময়। (অবশ্য ধন্যবাদ প্রাপ্য কমরেড ইউটিউব, তোমাকে লালসালাম।) :)
মার্কেজের মূল গল্পটা বহুবার পড়া। আমার খুবই 'অপ্রিয়' গল্প এটা। হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসগুলোর কিছু কিছু লাইন আছে এমন, পড়ার সময় মনের ওপর খুব চাপ পড়ে, হাসফাঁস লাগে, দম বন্ধ করা একটা অনুভুতি কাজ করতে থাকে মনে। মার্কেজের, বিশেষ করে এই গল্পটা তেমনি। যতক্ষণ পড়তে থাকি চারপাশের সবকিছুর ওপর অবিশ্বাস চলে আসে। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতায় হত বিহবল হয়ে পড়তে হয়। গল্পটা এরকম- রাতের অন্ধকারে পথ ভুল করে বসে একটা মেয়ে। বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে যে বাসে চড়ে বসে, সেটা ছিলো আসলে একটা মানসিক হাসপাতালের বাস। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটি, সকালে যখন উঠে, দেখতে পায়, হাসপাতালে নেমেছে সে, ডাক্তার ও নার্স পরিবেষ্টিত, এবং সবাই ভাবছে, সে-ও একজন মানসিক রোগী। মেয়েটা কোনভাবেই বিশ্বাস করাতে পারে না যে সে রোগী নয়, বারবার শুধু সে তার স্বামীকে ফোন করতে চায়, শুধুই আকুতি করে, একটা ফোন করা যাবে প্লিজ?
মার্কেজের মূল গল্পটা শেষ হয় বুকের ভেতরটা একদম দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে। গল্পে আছে, মেয়েটা ওই হাসপাতালেই থেকে যায় চিরকাল, ওর স্বামী বহুদিন পরে ওকে খুঁজে পায় সেখানে। কিন্তু কে জানে কার উপর অভিমানে সে আর ফিরে আসতে চায় না, ওখানেই থেকে যায় বাকি জীবন।
অমিতাভ রেজা গল্পটাকে নাটক বানানোর সময় আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপট দেখিয়েছেন। মেয়েটির ভূমিকায় ছিল সম্ভবত তাঁরই স্ত্রী, জেনি। ডাক্তার ছিলেন ইরেশ যাকের। প্রত্যেকের অভিনয়ই অনবদ্য ছিলো। প্রথমবার নাটকটি দেখার সময় মার্কেজের গল্প পড়ার সময়কার চাপটা টের পাচ্ছিলাম বেশ। নাটকের শেষটুকু দেখতে চাইছিলাম না একদম, জানিই তো কী হবে, আবারও মন খারাপে ডুবে যাবো। কিন্তু দেখি, অমিতাভ রেজা কাহিনি বদলেছেন ওখানে, নাটকের মেয়েটি শেষমেষ খুঁজে পায় ওর প্রেমিককে, এবং নাটকের শেষ পরিণতি হয় মিলনাত্মক।
আমি রীতিমত খুশি হয়ে গেছিলাম এই বদলে, মনে মনেই অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছি তাঁকে, মুগ্ধ হয়েছি তাঁর এডাপশানের মুন্সীয়ানায়।
*
গতকাল দেখলাম তাঁর বানানো এবারের ঈদের নাটক, [i]এ সময়[/i]।
নাটকের মূল গল্পটি নেয়া হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প 'মিলির হাতে স্টেনগান' থেকে। আশ্চর্য এ-ই যে, এ গল্পটিও আমার বহু বহুবার পড়া। আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পগুলোর একটি এটি। গল্প হিসেবে এটি অসম্ভব শক্তিশালী। কিছু কিছু গল্পের প্লট আছে, যেগুলো বেয়াড়া ঘোড়ার মতন, কেবলই তেড়ে ফুঁড়ে আসে, এগুলোকে লাগাম পড়ানো শক্ত কাজ। ইলিয়াস ছাড়া আর কেউ এই গল্পটি সামলাতে পারতেন কিনা, সে নিয়ে আমার ব্যাপক সন্দেহ।
তো, এই অসম্ভব প্রিয় গল্পের নাট্যরূপ দেখতে পাবো আরেকজন প্রিয় পরিচালকের হাতে, এই আশা নিয়েই নাটক দেখতে বসা।
নাটক খারাপ লাগেনি, নাটক হিসেবে এটি ভালই হয়েছে। কিন্তু গল্পটা জানা থাকায় খানিকটা হতাশ হয়েছি আমি।
গল্পটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ের। তরুণ যোদ্ধারা ফিরে এসে সবাই ঠিক পথে হাঁটেননি। কেউ কেউ বেছে নিয়েছিলেন অন্ধকার জগত, গল্পের মূলভাবটা সেরকমই। কিন্তু নাটকে, এটাকে একদম এই সময়ের গল্প বানিয়ে ফেলা হয়েছে। নাটকের অন্যতম মূল চরিত্র আব্বাস পাগলা। এই চরিত্রটি অবিকল ছিল অবশ্য, এবং বলা চলে গল্প আর নাটকের একমাত্র যোগসূত্রও ছিলো আব্বাস পাগলাই। গল্পে অন্ধাকার জগতের ব্যাপারটা ছিলো আবছায়ার মত, তার ফলাফল অবশ্য ছিল সামনেই। নাটকের প্রয়োজনেই হয়তো আবছায়াগুলোকে শরীর দেয়া হয়েছে, নতুন চরিত্র আনা হয়েছে অনেক, স্পষ্ট হয়েছে মিলির ভাই রানার কর্মকান্ড।
আমার অবশ্য মনে হয়েছে, এটার দরকার ছিলো না। এইটুকু স্পষ্টতা না দেখালেও চলতো। মূল গল্পকে অনুসরণ করে নাটকটা নির্মিত হলে আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠত সেটা।
মিলির হাতে স্টেনগান গল্পের আসল অংশ হচ্ছে এর শেষটুকু। যেখানে দেখায়, আব্বাস পাগলা ভাল হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু তাঁর কষ্টটুকু পাগলামি হয়ে ঢুকে পড়ে মিলির মাথায়, সে তখন ছাদের উপরে উঠে গিয়ে আকাশে উড়াল দেবার জন্যে পা ঝাপটায়।
আমার তীব্র আগ্রহ হচ্ছিলো, এটাকে চিত্রায়ন করা হয় কীভাবে তা দেখার। নাটকে ইলিয়াসের লেখার এই অনুভুতি নিয়ে আসা সহজ নয়। তো, [i]এ সময়[/i] নাটকটির শেষটুকু দেখেও আবারও খানিকটা হতাশই হতে হলো। ওরকম আবেদন আসেনি। নাটকটা হয়ে গেছে বিপথগামী কোন যুবকের বোনের গল্প, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের টানাপোড়া সেখানে অনুপস্থিত।
আগের বার খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু এইবার, এই বদলে মন খারাপ হলো।
জানি সম্ভব নয়, তবু যদি পারতাম, আমি অমিতাভ রেজাকেই অনুরোধ করতাম নাটকটা আরেকবার বানাতে, আর কাউকে নয়।