অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ এইবার তবে উলটো পথে চলো-

এখানকার একটা নামকরা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা পড়তে গিয়ে সম্ভবত প্রথম মাথায় আসে কথাটা। অথবা তারও আগে, হয়ত ঝুম্পা লাহিড়ি পড়ছিলাম যখন, তখন। অথবা, এখন মনে হচ্ছে আরও খানিক আগে, মার্কেজের গল্পগুলো যখন পড়ছিলাম, সম্ভবত তখনই।

সাহিত্যপাতায় যে গল্পটা পড়ছিলাম, সেটা আবার সে পত্রিকার সাহিত্য আয়োজনে প্রথম পুরষ্কারপ্রাপ্ত। গল্পের শুরুতে আলাদা রঙ ও ফন্টে সে কথা বিশেষভাবে জানান দেয়া, গল্পের মাঝামাঝি আলাদা একটা বাক্সে লেখকের নাতিদীর্ঘ পরিচিতি, এবং গল্পের সাথে মানানসই চমৎকার একটা ছবি। বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম, একজন লেখকের গল্প। ল্যাপটপে গল্প লিখতে গিয়ে তার কাছে গার্লফ্রেন্ডের ফোন আসে, গল্প না গার্লফ্রেন্ড এই দ্বিধায় কেটে যায় গল্পের বাকি অংশটুকু, সবশেষের লাইনে, দেখা যায় ল্যাপটপ খুলে রেখে লেখক বসে, মোবাইলটা সুইচ্ড অফ।
গল্পটা খারাপ লাগে না, পড়ে নিয়ে ভাবি, গল্পটা মন্দ নয়; কিন্তু তারপরেই ভাবি, গল্পটা আসলে কতটুকু ভাল?

ঝুম্পা লাহিড়ি পড়তে গিয়ে এমন হয়েছিলো। খুব ভাল লেগেছিলো ইন্টারপ্রেটার অব মেলাডিস, এই সহজ সরল বর্ণনা, বিষয় বাছাইয়ের সারল্য, সবই। কিন্তু মাথায় ঘুরছিলো ওয়ালীউল্লাহ বা হাসান আজিজুল হকের গল্পগুলোর ধার। তুলনা টানার প্রশ্নই আসে না, আমি ভাবছিলাম অন্য কিছু। ভাবছিলাম, শুধু ইংরেজিতে লেখা বলেই এই গল্পের লেখকেরা বিনা আয়াসেই কেমন করে পৌঁছে গেলেন আমার মতন একজন ভিনভাষীর কাছে।

কদিন আগে কোয়েটজি-র ডিসগ্রেস পড়ছিলাম, এখনো শেষ করিনি, কিন্তু পড়ার সময় খুব ভাল লাগছিলো, বর্ণনাগুলো কি টানটান, হুট করে গল্পের এমাথা ওমাথা এফোঁড় ওফোঁড় করে চিরে দেয়া কিছু দৃশ্যপট। আমার মনে হচ্ছিলো, আমাদের ইলিয়াসের গল্পের যে চমৎকারিত্ব, সেও কি কিছু কম?
আমার খানিকটা দুঃখবোধ হলো তখন। আমাদের ইলিয়াস, মানিক, মাহমুদুল হক, হাসান আজিজুল, এঁরা কেবল আমাদেরই রয়ে গেলেন, যাবেন, পুরো বিশ্বের পাঠকদের কাছে তাঁদের পৌছানো হবে না কোনদিন। কারণ, এনাদের সাহিত্যকর্ম কেবল বাংলায়ই পাওয়া যায়, ইংরেজি বা আর কোন ভাষায় নয়। অথচ যদি এঁদের লেখা পড়তে পেতো পুরো দুনিয়া,তবে বুঝতো, আমাদের এই সোঁদাগন্ধের বাংলা মাটিতে কতই না রত্ন ছড়িয়ে আছে!

মাইকেল মধুসুদন গোত্রীয় কোন ভাবনা আমার মাথায় চেপে বসেছে ভাবার কোন কারণ নাই। আমি বলছি না, আমাদের লেখকদের ইংরেজিতে লেখার দরকার ছিলো।
কদিন আগে সৈয়দ হক এর একটা লেখায় এরকম কিছু পড়েছিলাম, ফজলে লোহানী কোন এক আলাপচারিতায় তাঁকে বলেছিলেন ইংরেজিতে লিখতে। কারণ, ইংরেজির মাধ্যমেই পুরো পৃথিবির কাছে পৌঁছানো যায়। সৈয়দ হক, স্বভাবতই এ কথা কানে নেননি। আমারও সেই একই কথা। আমাদের লেখকদের ইংরেজিতে কেন লিখতে হবে? কেন তাঁদের লেখাগুলোকেই আমরা দায়িত্ব নিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিবো না?

অনুবাদ সাহিত্য আমাদের ভাষায় এখন পোক্ত আসন করে নিয়েছে। বিশ্বের নানান ভাষার ক্লাসিক বা শ্রেষ্ঠতম গল্প-উপন্যাসগুলো আমরা অনুবাদের কল্যাণে চট করে বাংলায় পড়ে ফেলতে পারছি। এ কারণে, আমি ব্যক্তিগতভাবে, আমাদের অনুবাদকদের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি ভাবছি, অনুবাদের ক্ষেত্রে এবার বোধহয় আমাদের উলটো পথে হাঁটবার সময় হয়ে এসেছে। বিশ্বসাহিত্যের বাংলা অনুবাদই শুধু নয়, এখন থেকে আমাদের বাংলা সাহিত্যর ইংরেজি অনুবাদ প্রকল্প নিয়েও ভাবা উচিৎ।

মার্কেজ পড়া শুরু করার পরে এই ভাবনাটা একটা পাকাপাকি আসন পেল মাথায়। আমি দেখলাম, মার্কেজ কি দারুণ ভাগ্যবান। উনি নিজের ভাষায়ই লিখেন, কিন্তু লিখবা মাত্রই সেসব অনুবাদ হয়ে চলে আসে আমাদের কাছে। রাশানরা একসময় পৃথিবি জুড়ে এই অনুবাদ প্রকল্প ছড়িয়ে দিয়েছিলো, তাদের গল্প-উপন্যাস, রূপকথা, সবকিছুর নানান ভাষার অনুবাদ পাওয়া যেত সবখানে। তাহলে আমরা পারবো না কেন? এরকম উদ্যোগ সরকারী বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নেয়া কি একেবারেই অসম্ভব?

আমি এখনো জানি না, বুঝতে পারি, অনেক বড় একটা প্রকল্প হয়তো এটা, হয়ত অনেক অর্থের প্রয়োজন। তবু আমার স্বপ্ন, কখনো যদি সুযোগ পাই, আমাদের ভাষার শ্রেষ্ঠ কাজগুলিকে অন্ততপক্ষে ইংরেজিতে অনুবাদ করার একটা উদ্যোগ অবশ্যই নেব।
আমার এরকম স্বপ্ন দেখতে ভাল লাগে, কাম্যুর যে আগন্তকের দুঃখে এই সুদূরে বসে আমি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি, অথবা মার্কেজের যে কর্নেলের পাশে বসে একটা কখনো-না-আসা চিঠির অপেক্ষা করি, তেমনি করেই হয়ত কোন একদিন সেই জর্মন বা স্পেনের কোন এক জানালায় বসা কোন এক কিশোর ইলিয়াসের হাড্ডি খিজিরের সাথে ঘুরে বেড়াবে ঢাকার গলি-ঘুপচি, অথবা মাহমুদুল হকের আব্দুল খালেকের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে রেখাকে ডেকে বলবে, গিরিবালা, ও গিরিবালা, তোমার এত রাগ কেন গো গিরিবালা?

ছোটবেলায় রচনা বইয়ে পড়েছিলাম, যদি এক কোটি টাকা পাইতাম, তবে সকল গুড় ভাত দিয়া খাইতাম।
আমি আজ ভাবি, এক কোটি টাকা সত্যিই যদি পাইতাম, তবে বাংলা সাহিত্য অনুবাদ করে দুনিয়াময় ছড়িয়ে দিতাম।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-