ঈশ্বর যেখানে অবশ্যই উপস্থিত-

অল্প কয়বছর হলো আমি খানিকটা সুস্থির হয়েছি, তার আগে, যখন ছোট ছিলাম, অথবা এমনকি কলেজে থাকাকালীনও, যাবতীয় রোগ বা অসুখের আমি খুব প্রিয় ছিলাম। যখন যে রোগের চল দেখা যেত, আমি বীরত্বের সাথে সেই রোগ বাঁধিয়ে বসতাম।


ক্লাস সেভেনের থার্ড টার্মে, আমাদের কলেজে একধারসে অনেকের চিকেন পক্স হয়ে গেলো। ক্লাসের বন্ধুরা একেকদিন ক্লাসে আসে, লানচের পরে গেমসে যাবার সময় দেখি হাসপাতালের বারান্দা থেকে তাদের বিগলিত হাসি। কী হয়েছে? না, ওনারা চিকেন পক্স বাঁধিয়ে বসেছেন। আগামী একুশ দিন তাদের কলেজের যাবতীয় পিটি-প্যারেড-পাঙ্গা থেকে ছুটি! কি মজা, আমি নিশ্চিত যে আমারও হবে। কিন্তু টার্ম প্রায় শেষ হতে চললো আমার পক্সের কোন লক্ষণ নেই। বিরক্ত হয়ে ভাবছি ব্যাপার কী? তো, টার্ম শেষের তিন দিন আগে পক্স বাবাজী ভাবলেন, এ ছেলেকে হতাশ করে কী লাভ? তিনি আমাতে অবতীর্ণ হলেন। সবাই যখন ছুটিতে যাবার আনন্দে মশগুল, আমি তখন বিরস বদনে হাসপাতালে গেলাম।
একুশ দিনের ছুটির আঠারো দিনই আমার ঘরবন্দী কেটে গেলো, বিছানায়।

এরকম কম ঘটেনি। হাত-কাটা বা পা-ভাঙ্গা, এসব সাধারণ ঝামেলা বাদেও আমি নিজ থেকে আরও ভয়াবহ সব অসুখে পড়তাম নির্দ্বিধায়!
এর ধারাবাহিকতা কাটলো না কলেজ থেকে বেরুবার পরেও।
২০০০ সাল। পরীক্ষা টরীক্ষা দিয়ে আমরা তখন ঢাকায় নিজেদের ভবিষ্যৎ খুঁজে বেড়ানোয় ব্যস্ত। আমার মত মফস্বলের ছেলেরা কেউ মেসে, কেউ বা আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। আমিও তাই।
তো এরকমই এক সুন্দর বিকেলে, বাইরে তখন কন্যাসুন্দর আলো, এরকম সময়ে নাকি লোকের মাথায় প্রজাপতি বসে। আমি অভাগা মানুষ, প্রজাপতি কপালে নাই, তাই সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আমার ঘাড়ের পাশে এসে টুক করে বসলো এক….। হু, কী আবার, এক ডেঙ্গু মশা! তিনি এসে হাল্কা আদরে আমার চামড়ায় হুল ফুটিয়ে দিলেন, আমি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলাম।
এরকমটা অবশ্য আগেই ভেবেছিলাম। কারণ সে বছরই কেবল এই বিদঘুটে নামের জ্বরের প্রকোপ শুরু হয়েছে। পত্রিকার পাতা খুললে চমকে উঠতাম, নানা জায়গায় অনেক লোক মরছে, মৃতদের নামের তালিকায় কয়েকজন ডাক্তার থাকায় লোকেদের আতঙ্ক একেবারে তুঙ্গে। আমি আগেই বুঝেছিলাম, এরকম একটা মহিমান্বিত অসুখ আমার না হয়ে যাবে কোথা?

হলো, কদিন জ্বরে ভুগলাম। কেউ অবশ্য শুরুতে বুঝলো না যে এটাই ডেঙ্গু। কুমিল্লা থেকে মামা এসে আমাকে নিয়ে গেল বাসায়। সেখানে গিয়েও জ্বর কমে না। দুদিন পরে শুরু হলো অসহ্য হাড়ব্যথা। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে। ডাক্তার এলেন, নানান পরীক্ষা চালালেন, নার্স এলেন ইন্জেকশান নিয়ে। এসে তিনি সুইয়ের বদলে সোজা আমার দিল মে চাক্কু বসিয়ে দিলেন!
কানে কানে বলি, ডেঙ্গুর প্রকোপে আমার তখন জান যায় যায়, তার মধ্যেও পষ্ট বুঝলাম, জীবনে এর চেয়ে সুন্দরী নার্স দেখা আমার কপালে নাই। সাদা পোষাকে যেন সাক্ষাৎ হীরামনের গল্প থেকে উঠে আসা পরী।
হায়! সেই আনন্দ বেশিক্ষণ টিকলো না। ডাক্তার ধরে ফেললেন, মানে, আমাকে না, আমার অসুখকে। তিনি বাংলা সিনেমার জাজদের চেয়েও বেশিরকম বিষন্ন সুরে ঘোষনা দিলেন, মহাশয়ের ডেঙ্গু হয়েছে।

আমি শুনে বেকুব হয়ে গেলাম। মাথার মধ্যে ঘুরছিলো পত্রিকা আর টেলিভিশনে দেখা মৃত্যুসংবাদগুলো। আমার বাসার সবার অবস্থাও কাহিল। মোটামুটি মরাকান্না জুটিয়ে দিলো সকলে। এর মধ্যেই এম্বুলেন্সে করে আমাকে নিয়ে আসা হলো ঢাকা মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালে।
সেখানে বেশ কদিন ছিলাম। ভাল হয়ে উঠেছিলাম আস্তে আস্তে। তবে সে অন্য গল্প। আজ আর ওদিকে যাবো না।
এসব কথা আজ হুট করে মনে পড়ে গেলো ফেইসবুকে একটা ভিডিও দেখে। ঢাকা মেডিক্যালেরই সেটা। যেখানে রাত গভীর হলে ওয়ার্ড বয় আর সুইপাররা ডাক্তার বনে যান। অষুধ প্রেসক্রাইব করাই শুধু নয়, ওনারা অপারেশনও করেন!



ভিডিও দেখে আমি নিজের ভাগ্যকে হাজার কোটিবার ধন্যবাদ দিলাম, এই সময়ে আমাকে অসুখে পড়ে সেখানে যেতে হলো না বলে। ধন্যবাদ দিলাম সেই রূপবতী ডেঙ্গু মশাটাকেও, আর নয় বছর দেরিতে কামড়ালেই আমাকে আর দেখতে হতো না।
ঈশ্বরবিশ্বাসীরা প্রায়শই নাস্তিকদের সোজা পথে আনানোর জন্যে নানান আলামত হাজির করেন। এই ভিডিও দেখে আমার মনে হলো, সেসবের কোন দরকারই নেই। তাদের সবাইকে একবার করে ঢাকা মেডিক্যালে ঘুরিয়ে আনা হোক। ওয়ার্ড বয় বা সুইপারের হাতে অপারেশন হবার পরেও স্বয়ং ঈশ্বর ব্যাতীত আর কেউ তাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন, আর যে করুক, আমি অন্তত এ কথা বিশ্বাস করি না!

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-