একটা রূপকথা

দেখি, আজ একটা গল্প বলি বরং।
এক বাড়ির বড় ছেলে নতুন বিয়ে করে খুব লক্ষীমন্ত একটা মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসলো। দুইজনে খুব ভাব-ভালবাসা, খুব মিল-ঝিল। নিজেদের মত করে সুখেদুখে দিন কাটায়।
বাড়ির বাকি লোকজনের আবার এটা পছন্দ হলো না। রূপকথার কূটনী বুড়িদের মত তাদের চোখ টাটাতে লাগলো এত সুখ দেখে। তারা নানান মিটিং-টিটিং করে একসাথে নানান রকম ফন্দি-ফিকির করতে লাগলো। বৌ-টার লক্ষীপনাকে বললো ন্যাকামী, লাগাল সেটা ছেলেটার কানে। কিন্তু ছেলে সেসবে কানই দিলো না, বউটাকে যে সে খুব ভালমতন চেনে। বাড়ীর সবার সব কূট-বুদ্ধি বিফলে গেলো।
এদিকে কদিন পরে, মেয়েটার শরীর খারাপ হলো। কী ব্যাপার কী ব্যাপার? ছেলে ডাক্তার-বদ্যি ডেকে আনলো। ও মা, জানা গেলো, সে তো ভারী সুখের খবর। মেয়ে যে মা হবে!
ছেলে আর বৌয়ের মনে কী খুশি! আনন্দে তারা ডুবে ডুবে যায়। কিন্তু বাড়ির লোকের আবারো চোখ টাটায়। তারা ঠিক করলো এতদিন যেমন তেমন, এইবারে আর ছাড়াছাড়ি নেই। ওদের যেহেতু কিছু করতে পারেনি, ওদের সন্তানেরই অনিষ্ট করবে তারা।
তো, দিন যায়, মাস যায়। নয় মাস বাদে মায়ের প্রসব ব্যাথা ওঠে, আতুঁড় ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে, অনেক যন্ত্রণা আর কষ্টের পরে মা-টা একটা ফুটফুটে চাঁদের মত মেয়ের জন্ম দিলো। সেই ফুটফুটে মুখ দেখে পাখীদেরও মন ভরে যায়, ফুলেদেরও হাসি খেলে যায়।
কিন্তু বাড়ীর লোকেদের তা সইবে কেন, তারা করলো কী, সেই ছোট্ট পরীর মতন বাবুটার একটা হাত ভেঙে দিলো। বাবুটা আকাশ কাঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। সেই কান্নায় মেঘেদেরও চোখ ভিজে যায়। কিন্তু সেই পিশাচদের মন ভেজে না। তারা এবার বাবুটার আরেকটা পা ভেঙে দেয় মট করে। আর কষ্টে যন্ত্রণায় বাবুটা চিৎকার করে ওঠে, সারা পৃথিবী নিস্তব্ধ হয়ে যায় সেই দুখে।
এমনি করে জন্মের সময়ই সেই পিশাচেরা ছোট্ট বাবুটাকে পঙ্গু করে দেয়, যেন বেঁচে গেলেও সে পিঠ সোজা করে দাঁড়াতে না পারে সহজে।

আচ্ছা, আপনাদের কী মনে হয়? অনেকবছর পরে যখন ঐ পঙ্গু মেয়েটার সন্তানেরা সেইসব পিশাচদের পরিচয় জানবে, তখন তারা কী করবে?

*

আপনারা হয়তো জানেন না, নাকি জানেন?
আজ থেকে অনেকবছর আগে, এই দিনে, এই ১৪ ডিসেম্বরে, আমাদের মা, এই মাতৃভূমি, এই বাংলাদেশের জন্মের ঠিক আগমুহুর্তে, আমাদের মাকেও পঙ্গু করে ফেলার ষড়যন্ত্র হয়েছিলো। যে সন্তানদের উপর ভরসা করে জন্মের পরে এই দেশটা মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে পারতো, সেই সন্তানদের, সেই শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিকদের তালিকা বানিয়ে বানিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো।

এই পঙ্গু মায়েরই সন্তান আমি। সেই পিশাচদের পরিচয়ও জানি। কিন্তু আমার আসলে কিছুই করার নেই। কেবল প্রতি বছর এই দিনটিতে ভীষণ মন খারাপ করে বসে থাকা ছাড়া।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-