কামরুল-বন্দনা

(হেডনোট, অথবা শিরঃটীকা- এই লেখার মূল উদ্দেশ্য দুইটি।
এক- বন্ধুদের ঢোল বাজাতে আমার ব্যাপক ভাল লাগে। সুযোগ পেলেই বাজাই।
দুই- খেয়াল করে দেখলাম, এই ব্লগের হার্টথ্রব কামরুল একাই আমাদের বন্ধুদের নিয়ে লিখছে। আমি ভাবলাম, আজ নাহয় আমিই কামরুলকে নিয়ে কিছু লিখি। )

আমরা সবাইই কুমিল্লার ছেলেপেলে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, পড়েছি সবাই জিলা স্কুলে। তারপরেও কামরুলের সাথে আমাদের পরিচয় হতে খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিলো। কারণ সম্ভবত এই যে, সেভেনের পর থেকে আমাদের কলেজ আলাদা হয়ে গিয়েছিলো।
সম্ভবত নাইন বা টেনের কোন একটা সময়ে কোন এক টিউটরের বাসায় দরজায় দাঁড়িয়ে আমি চেঁচামেচি করছি, এইসময় ছোটখাটো সাইজের একটা ছেলে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কী রে, কেমন আছিস?
আমি চিনলাম না।
ঐ সময়টায় এরকম আমার প্রায়ই হতো যে রাস্তায় কারও সাথে দেখা হলো, আমার কুশল জিজ্ঞেস করছে, কেমনাছি, কীকর্ছি, নানান হাবিজাবি। প্রথম দিকে দুয়েকবার লোকজনের মনে দুঃখ দিয়ে ফেলতাম। পরে শুধরে নিয়েছি, কোনভাবেই আর টের পেতে দিতাম না যে আমি আসলে মানুষটাকে চিনতে পারছি না।
এবারও তাই করলাম। চিনতে না পেরে, দুপলক শুধু, তারপরেই একদম স্বাভাবিক স্বরে বললাম, এই তো ভাল আছি, তোর কী খবর?
কামরুল আমার দুই নম্বুরী মূহুর্তেই ধরে ফেললো, বললো, আমারে চিনস?
আমি পুরাই বেকুব। মাথা টাথা চুলকে স্বীকার করলাম যে আসলে চিনি নাই।
সেই থেকে শুরু।

আমাদের হু আ
———————–
হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে এখন অবশ্য অল্প কিছু মুশকিল আছে। ভদ্রলোকের জনপ্রিয়তা কদিন সাইন কার্ভ হয়ে ওঠা নামা করে এখন মোটামুটি নেগেটিভে চলে গেছে।
কিন্তু আমরা যে সময়টায় বইয়ে মুখ গুঁজে বড় হয়েছি, আমাদের সময়ের অনেকটা জুড়ে ছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। আমাদের খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি।
তো, আসলে, কামরুল ছিলো আমাদের হুমায়ুন আহমেদ।
হুমায়ুন মানেই যেমন ছিলো, দারুণ রসিক কেউ, বা অনাবিল বিনোদন। কামরুলও তাই।
সিলেট ক্যাডেট কলেজের অসম্ভব মজার গল্পগুলো আমার ধারণা সিলেটের পোলাপানের চেয়ে আমরা ভালো জানি। ছুটিতে বাসায় এলেই কুমিল্লা টাউন হলের শহীদ মিনার বা লাইব্রেরীর সিঁড়িতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা চলতো। আমি মোটেও গল্পবাজ কেউ নই। যে কোন আড্ডায়ই আমার মূল ভূমিকা মনোযোগী শ্রোতা। কিন্তু সেই আড্ডাগুলোয় দেখা যেত একা আমিই কেবল নই, বাদ বাকি সবাইও আমার মতই শ্রোতায় পরিণত হয়ে গেছে। আর আমাদের মধ্যে এক এবং অদ্বিতীয় বক্তা হলো কামরুল।

একটু দেরিতে পরিচয়ের কারণেই হয়তো কামরুল দ্রুতই শুরুর ঘাটতিটুকু ধুমধাম পুষিয়ে দিতে শুরু করলো। আমাদের কুমিল্লা পার্টির সকল আড্ডার মধ্যমণি হয়ে গেলো কামরুল।
ওর গল্পের ঢং পুরাই জাদুকরী। যে কোন কথাই এমন সুন্দর করে ব্যাটা বলে যে, মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয় বসে বসে। জিহাদ, রায়হান বা আর সব পিচ্চিগুলার মনে আছে কিনা জানি না, সিসিবি-র একদম শুরুর দিকে আমরা হাতে গোণা কজন যখন এখানে লিখতাম, তখনও আমি ওদের বলেছি, কোন মতে যদি পারো, কামরুলকে ধরে নিয়ে আসো। দেখবা গল্প কারে বলে।
আর বলে দিতে হয় না, আমার ধারণা এখানের সবাইই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমার কথা হাড়ে হাড়ে ফলেছে।

আবার নচিকেতাও
—————–
সিসিবি-র আড্ডায় ব্যাটা গান গেয়েছে কি না জানি না। কামরুল কিন্তু মারাত্মক গান গায়। হুমায়ুনের সাথে সাথে ও আমাদের নচিকেতাও। পৌলমী বা শতাব্দী গান দুটো কামরুলের কাছেই প্রথম শোনা, ওর গলাতেই। আবার নীলাঞ্জনাকে যখন খোলা বারান্দায় ঝুলে থাকতে দেখা যায়, কামরুলের গলায় সেটা শুনতেও অদ্ভুত ভাল লাগে।
অল্প বিস্তর কৃতজ্ঞতাও রয়ে গেছে ওর প্রতি।
শিমুল মুস্তাফার একটা অসাধারণ আবৃত্তি আছে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। দেশে এবং প্রবাসে এমন অনেক দিন গেছে, যে বহু বহুবার রিপিট করে এই আবৃত্তি শুনেছি।
দুর্দান্ত এই আবৃত্তিটাও প্রথম শোনা হয় কামরুলের কল্যাণে।

পুকুর পাড়ের কামরুল
——————–
কামরুলের এই নামকরণের পেছনে একটা কারণ আছে।
ঢাবি-র প্রথম বর্ষে আমি তখন একুশে হলে থাকি। কামরুল শহীদুল্লায়। তো কার্জনে ক্লাশ শেষে অথবা ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আমরা ফিজিক্সের কিছু পোলাপান প্রায় সারাক্ষণই শহীদুল্লাহ-র পুকুর পাড়ে বসে থাকি। আর ওখানে গেলেই আমার কমন রুটিন ছিলো কোন এক ফাঁকে চট করে উঠে কামরুলের রুমে গিয়ে ওর সাথে দেখা করে আসা।
ব্যাপারটা এতই নিয়মিত ছিলো যে, প্রায় অনেকদিনের বাদে কামরুলকে যখন আমার ফিজিক্সের বন্ধুদের সাথে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিলাম, আমার তৎকালীন ছায়াসঙ্গিনী (পরবর্তীতে প্রেমিকা ও অতঃপর বউ) বলে উঠলো, আচ্ছা! এই তাহলে পুকুর পাড়ের কামরুল!!!

এখন নাকি ফারুকী
——————
কামরুল এখন নাটক বানায়। দুর্ভাগ্য এই যে কেবলই শুনেছি, দেখার কপাল হয়নি। লোকমুখে শুনি নাটকগুলো নাকি বেশ ভাল হয়। অনেকবার ব্যাটারে বলেছি দুয়েকটা ইউটিউবে দয়া আপলোড কর, একটু দেখি। না, শালা দেখায় না।
তো বানাক নাটক, ফারুকী হোক, দিনে দিনে জহির রায়হান হোক। সিনেমা বানাক দারুন দারুণ।
ওহ, সিনেমার কথা বলতেই মনে পড়ে গেলো।
কলেজের ছুটিগুলোয় কোন কোন দুপুরে আমরা সবাই কামরুলের বাসায় জড়ো হতাম। অনেকগুলা কারণ ছিলো তার, সবচেয়ে আসল কারণ, আমাদের সবার মধ্যে ওর ভিসিআরটাই সবচেয়ে নতুন ছিলো। আর, দৈবক্রমে দুপুরগুলোয় ওদের টিভিটাই খালি পাবার সম্ভাবনা ছিলো বেশি। বাকি আর কিছু বলতে হবে?

…..তারপর
———–
কামরুল এরকমই আমাদের কাছে। গল্পবাজ, সারাক্ষণ হাসি আনন্দে ভরে থাকা, এবং চারপাশের সবাইকে ভরিয়ে রাখা একটা মানুষ।
আমি জানি, জীবনের একটা অংশ বা স্মৃতির একটা টুকরো শুধু আমরা কুমিল্লার বন্ধুরা ওর সাথে শেয়ার করেছি। এর মধ্যেই কামরুল আমাদের হুআ, নচিকেতা, ফারুকী বা পুকুর পাড়ের কামরুল।
সত্যি কথা বলতে কী, এই লেখাটা লেখার জন্যে আমি আসলে যোগ্য ব্যাক্তি নই। সিলেটের বন্ধুরা কামরুলের আরও কাছের, আরও আপন। এবং কামরুলের মাহাত্ম আসলে সবচেয়ে ভাল বলতে পারবে ওরাই।

আমি আসলে ঢোলে একটা বাড়ি দিয়ে গেলাম। বাকীরা এসে বাজাতে থাকুক এইবার, আমি দেখি।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-