হাওয়াই মিঠাই ১১

কদিন আগে, সম্ভবত প্রায় বছর দশেক বাদে, মাঝরাতের শো শেষ করে সিনেমা দেখে ফিরতে ফিরতে এক্স ফাইলসের সুরটা শিস দিয়ে বাজালাম। এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ, থেমে থেমে লম্বা সময়। দেখলাম, এত দিনের অনভ্যাসে ভুলিনি তবু, ভালই বাজাতে পারলাম।

সিনেমাটা খারাপ লাগেনি। অনেক আগে টিভি পর্দায় দেখা পর্বগুলোর সাথে তেমন কোন পার্থক্য নেই অবশ্য। আমার মনে হলো, শ্লথ গতির কারণে একদম নতুন দর্শকেরা হয়তো হতাশ হবে, কিন্তু আমাদের মত কিছু দর্শক, যারা পুরোনো স্মৃতি খুঁড়ে ভাললাগা জাগাতে চাইবে, তাদের খুব একটা খারাপ লাগবে না।
অবশ্য মুভিটা নয়, আমি ভাবছিলাম অন্য কথা।
ভাবছিলাম, টিভি পর্দায় যখন খুব উত্তেজনা নিয়ে এক্স ফাইলস দেখার জন্যে অপেক্ষা করতাম, সেটা সত্যিই কি দশ বছর আগের কথা?

বড় হয়ে যাচ্ছি, হতে হতে বুড়োর পথে যাচ্ছি, এইরকম একটা ভাবনা প্রতিনিয়তই আমাকে বিমর্ষ করে। আমার সত্যিই আর বড় হতে ইচ্ছে করে না, ঠিক এইখান থেকে যদি এবাউট টার্ণ নেয়া যেতো, নিয়ে নিতাম। ইতিমধ্যেই জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে এসেছি যে, সেখান থেকে যখন তখন দশ বা বারো বছরের এক-একটা টুকরো তুলে নিয়ে পরে স্মৃতিচারণ করতে পারছি, এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে?

এরকম করে ভাবতে চাই না, তবু বারবার এইরকম ভাবনাগুলোই ঘুরে ফিরে হাজির হয়।

আমার এক বাল্যবন্ধুর জন্মদিন গেল কদিন আগেই। রাত দুপুরে ফোন করেছি শুভেচ্ছা জানাতে, হাবিজাবি নানা কথা হতে লাগলো। বিয়ে করিস না ক্যান, বুড়ো হয়ে যাচ্ছিস- এইসব বলে খুব ক্ষ্যাপাতে লাগলাম, বন্ধুদের জন্মদিনগুলোয় উইশ করার এটাই এখন সবচেয়ে স্বাভাবিক পন্থা। তারপরে হঠাৎই জিগেস করলাম, আচ্ছা বয়েস কত হলো রে? উত্তর পেলাম, সাতাশ! শুনে চমকে উঠি! সাতাশ হয়ে গেছে আমাদের বয়েস! বছর ঘুরে যায়, কিন্তু কখনো আলাদা ক‌রে বয়েস হিসেব করি না, দরকার পড়ে না। তাই আচম্বিতে সঠিক সংখ্যাটার উচ্চারণ শুনে হজম হলো না। ইস, কেন সাতাশ হলো? এর চেয়ে পনেরো কত ভালো ছিলো, সেই সময়ের হঠাৎ ছোট হয়ে যাওয়া হাফপ্যান্টের মতই ছিলো বয়েসটা, এদিকে টানলে যেন ওদিকে কম পড়ে!
আর আঠারো? হায়, বুঝবার আগেই শালিক পাখির মত ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল সেটা, টেরই পেলাম না।

ব্লগে বা ফেইসবুকে কলেজের ছোট ভাইদের যখন গুরুগম্ভীর আলাপ করতে দেখি, অথবা আমাদের বন্ধুরাই যখন মেসেজে জানায়, অমুক অফিসের বিরাট পোস্টে সদ্যই ঢুকলো আজ, বা অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন ডে-র ছবিতে শিক্ষকের সারিতে যখন দেখি বন্ধুর মুখ, বা এইসবই বাদ দিলাম, এই আমিই যখন দশটা পাঁচটা কাজের শেষে পাক্কা সংসারীর মতন ভিয়েতনামিজ বাজারে গিয়ে পাকা টমেটোর কেজির দর জিজ্ঞেস করি, তখন সত্যিই মনে হয়, কি-বা দরকার ছিলো এসবের? এর চেয়ে কত ভাল ছিলো বছর শেষে পুরনো বই ফেলে দিয়ে নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে নিতে অপেক্ষা করতে থাকা ছেলেবেলার সময়গুলো!

সচলায়তনেই মাঝে মাঝে পোল ছাড়া হয় নানা রকম, আমি উৎসাহভরে সেসবে ভোট দিই। কদিন আগেই এলো নতুন জরিপ, কোন বয়স-গ্রুপে আপনি? তো, আর কি, ওই পাতা খুলে চোখ বুজে "আঠারো থেকে পঁচিশ" গ্রুপে ক্লিক করতে যেতেই মনে পড়লো, নাহ, মেঘে মেঘে বেলা অনেক বেড়েছে হে বৎস, এইখানে তোমার আর প্রবেশাধিকার নাই! মন খারাপ করে পরেরটায় ক্লিক করলাম।

জীবনে জটিলতা বাড়ে শুধু। ভিনদেশে থাকি, নানান কাগজ পত্রের জোগান দিয়ে চলতে হয় সারাক্ষণ, মহাযজ্ঞসম ব্যাপার স্যাপার, মাঝে মাঝেই অস্থির লাগে এসবে। দেশে ফোন করলে টের পাই, বয়সের অংক শুধু বুড়োই করেনি আমাকে, নানা র‌ক‌ম দায়িত্বের প্যাকেট এনে তুলে দিয়েছে ঘাড়ে, গ‌ম্ভীর হ‌য়ে সেস‌ব নিয়ে মাথা ঘামাই। কাজের জায়‌গায় দায়িত্ব বাড়ে, প‌ড়াশোনাকে বিদায় জানাচ্ছি শিঘ্রী, তার‌প‌রে ন‌তুন জ‌ব নিয়ে ছুটোছুটি- এত‌স‌ব ঝামেলা না চাইলেও যেন আমাকে জোর ক‌রে আমার ব‌য়‌সের ক‌থা ম‌নে ক‌রিয়ে দেয়, কানের পাশে চেঁচিয়ে ব‌ল‌তে থাকে, বেলা বয়ে যায়!

এটা আজব একটা দুনিয়া। এর কাছ থেকে লুকোবারও কোন উপায় নেই। মাগনায় এর আলো-হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকছো, তার শোধ এইভাবেই তোলে এই পৃথিবী, পদে পদে তোমাকে মনে করিয়ে দেয় সময়ের কথা। আমি দরজা জানলা আটকে তাই ঘাড় গুঁজে বসে বই পড়ি। ব্যাটারি শেষ হয়ে ঘড়ির টিক টিক থেমে যায়, আমি তাতেই সময় আটকে দিয়েছি ভেবে উল্লাসে নেচে উঠি। পৃথিবীর যাবতীয় গোলমাল আমার ভাল লাগে না, সময় বয়ে যাওয়া ভাল লাগে না, বয়েস বেড়ে যাওয়াও ভাল লাগে না। উল্টো ঘুরে হাঁটা দিতে চাই, কিন্তু পারি না।
তারচেয়ে বরং সচলই ভাল। জরিপের ভোট তবু তো সে ফিরিয়ে নিতে দেয়। মাউস হাতে নিয়ে আমি ভোট ফিরিয়ে নিই, তারপরে চকচকে চোখে ক্লিক করে দিই "আঠারো থেকে পঁচিশ"-এর ঘরে, সচলায়তন রাগ করে না।

বাইরের ছুটে চলা দুনিয়াকে কাঁচকলা দেখিয়ে আমি এইভাবেই বয়স কমিয়ে যাই, কেউ টের পায় না।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-