ইতাক তুকে মানাইছেনাই রে

এই মিঠে-মন্দ রোদ আর বাতাসে পথ হাঁটতে গেলেই গা জুড়িয়ে আসে আরামে। খুব সাদা, অনেক কালো আর আমার মতন বাদামী রঙের মানুষদের মাঝখান দিয়ে অনায়াস দক্ষতায় গা বাঁচিয়ে পাশ কেটে কেটে হেঁটে বেড়াই। পথ চলতে, কানে ভেসে আসে নানান ভাষার কিচির-মিচির। তবু হঠাৎ কেউ যখন বাংলায় কথা কয়ে ওঠে, আনমনেই পা থেমে যায়। চিড়িয়াখানায় অনেক দিন আগে দেখা বন্দি সেই চিত্রল হরিণের মত কান খাড়া করে ফেলি, আরো খানিকটা কথা বলুক মানুষটা, আরও খানিকটা বাংলা না হয় শুনি।

আমাদের প্রতিবেশী হলো একটা ছোট্ট শিশু-পার্ক। গাছ-গাছালি তেমন নেই, মাঝখানে অনেকগুলো দোলনা, বেয়ে বেয়ে উঠে যাবার বা গড়িয়ে নেমে যাবার ছেলেমানুষী কাঠামো সব। প্রতি বিকেলে অনেকগুলো মানবশিশু, ঠিক যেন স্বর্গ থেকেই নেমে আসে এখানটায়। বাথটাবের ওপরে বহু যত্নে উঠে দাঁড়িয়ে একদিন আবিষ্কার করি, সেই স্বর্গছেড়াদের কেউ কেউ আধো আধো বোলে বাংলায় অভিমান করে তাদের বাবা-মায়ের সাথে। আমার আড়িপাতার হার দিনে দিনে বেড়ে যায়, ছোট্ট আর আদুরে সেই মুখগুলো থেকে মধু মাখা বাংলা শুনে শুনে মন জুড়িয়ে যায়।

বাড়ির পাশের পাঠাগার খুব অল্প সময়েই আমার প্রিয় জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের দারুণ টানাটানি, তবু সপ্তাহে একদিন গিয়ে ঢুঁ মারি ওখানে। একগাদা বই নিয়ে আসি, কিছু পড়ি কিছু পড়ি না, পড়া বইই বারে বারে পড়ি। এরকম চলতে চলতে মনে পড়ে আরেক পাঠাগারের কথা, বাংলা বই মেলে ওখানে। যেতে আসতে কমসে কম সত্তর কিলোমিটারের হ্যাপা, তবু মন টানে, একদিন ঠিকই সময় করে চলে যাই। নিয়ে আসি পড়া না পড়া অনেক বই। তারপরে রুটিন বদলে যায়, ওখানে যাওয়া আসার ঘনত্ব বেড়ে যায় আমার, বাড়ির পাশের পাঠাগার পর হয়ে যায়, পয়ত্রিশ মাইল দুরবর্তী কোন এক সতীনের অভিশাপে মশগুল সে তখন।

কোন এক রোদ্দুর ভরা দুপুরে শহরের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই চমকে উঠি। অফিসফেরতা একগাদা মানুষ। কোট-স্যুট-টাই, পরিপাটী, অথবা কালো স্কার্ট আর সাদা শার্ট। এর মাঝেই, কি আশ্চর্য, গোলাপী রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা এক কমবয়েসী মেয়ে দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক, চোখে বিহ্বল দৃষ্টি। বুকের ওপরে হাতের ফাইলটা এমন করে ধরা, যেন কার্জন হলের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়া কোন সদ্য তরুনী।

আমাকে অবাক করে এই ভর দুপুরেই ওর সামনে এসে দাঁড়ায় চৈতালী বা শ্রাবণের লাস্ট বাস, ভেলপুরী হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাস-মামার চোখে পড়ার চেষ্টায় ছুটছে সেই মেয়ে...।

এইসব দেখে আমি প্রতিনিয়ত চোখ বুজি। সমুদ্র পেরিয়ে কোন এক দুরবর্তী সবুজ দেশের কোন একটা লাল পাহাড় আমার মনের ভেতর গুন গুন করে গাইতে থাকে, ইতাক তুকে মানাইছেনাই রে, ইক্কেবারে মানাইছেনাই রে।

আমি মনের ভেতরে কান চেপে বসে থাকি, এইসব মিথ্যে গানের কী-ই বা মানে হয়!

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-