জয় বাবা ব্লগোনাথ

যে কোন আড্ডাতেই নিজের গ্রুপের মানুষ খুঁজে নেবার একটা অদৃশ্য প্রবণতা কাজ করে সবার মধ্যে। সাধারণত নতুন আড্ডায় হয় এরকম, অথবা বড়সড় ঘরোয়া চা-চক্রেও।
এ সব গ্রুপের অবশ্য কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কোন শহরে বড় হওয়া, এই দিয়েই জিজ্ঞাসা শুরু হয়, উত্তর মিলে গেলে এনারা একটা গ্রুপ। যদি না হয়, তাতেই বা কী, পরের প্রশ্ন 'কোন কলেজ যেন?'। তারপরে আছে, এসএসসি কবে, এইচএসসি?
তো যুগ বদলে গেছে, আন্তর্জালের মাধ্যমে আমরা হয়েছি আরো আন্তর্জাতিক, তাই এই পর পর প্রশ্নে খুঁজে নেবার তালিকায় সম্প্রতি আরেকটা প্রশ্ন যোগ হয়েছে, ' কি ভাই, কোন ব্লগে লিখেন আপনি?'

:-)
একটু বেশিই বলে ফেললাম অবশ্য। বাস্তবে এখনও এরকমটা হয় নি, তবে খুব শিগগীরই হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত। আমি অন্তত সেরকমই আলামত পেলাম।

সম্প্রতি এক আড্ডায় যাবার 'সৌভাগ্য' হলো। সৌভাগ্য ইনভার্টেড কমায় লেখা, কারণ সাধারণত বাংলাদেশিদের আড্ডা আমার অপছন্দের। আগেও বলেছি, মুল কারণ হলো দেশ-বিষয়ক হতাশাব্যঞ্জক কথাবার্তায় আমার স্পষ্ট এলার্জি আছে। একদমই সহ্য হয় না। এছাড়াও রয়েছে গসিপ-প্রিয়তা। মোটামুটি সাইজের একটা সামাবেশে উপস্থিত থাকলেই অত্র এলাকার সকল বংগদেশীদের নাড়ি-নক্ষত্র জানা হয়ে যায়।

আমি নিজে মহাপুরুষ নই। লোকের নিন্দা শুরু হলে আমিও তাতে হুট করেই যোগ দিয়ে ফেলি। আর এই ব্যাপারখানা এড়াতে চাই বলেও আমার বংগ-সমাজ-প্রিয়তায় খানিকটা ঘাটতি হয়েছে।

সেদিন, ক্যানবেরা থেকে আমাদের পুর্বপরিচিত এক দম্পতি এলেন এখানে, ইস্টারের কল্যাণে পাওয়া লম্বা ছুটিতে তারা ঘুরে দেখবেন মেলবোর্ণ। সন্ধ্যায় এসে পৌঁছলেন তাঁরা, দেখা করতে আমরা দুইজন রাত এগারোটায় ছুটলাম আন-বাড়ি।

আমার সকল স্বতস্ফূর্ততা আমার লেখার খাতায়।
সামনাসামনি আড্ডায় বসলে আমি ভীষণ মুখচোরা হয়ে যাই, বিশেষ করে গিয়ে যদি পড়ি সদ্য-পরিচিতদের মাঝখানে। আমি আর তিথি বাদে ওখানে বাকি সবাইই আমাদের অনেক সিনিয়র; জীবনযাত্রার জটিলতায় এখনো সেরকম মারপ্যাঁচের শিকার হই নি আমরা, তাই বসে বসে তাঁদের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হচ্ছিলাম। সেই ধরাবাঁধা প্রশ্নমালা অনুযায়ী একবার অবশ্য শহরের নাম উল্লেখ করে এন্ট্রি নেবার মৃদু চেষ্টা করেছিলাম, সে চেষ্টা সফল হয় নি।

তখন আচমকাই কোন কথা থেকে কোন কথায় ঘুরে ফিরে যেন ব্লগের কথা উঠলো। তখুনি জানা গেলো, ওখানে একজন নামকরা ব্লগারও বসে আছেন। আমি এইবারে পালে খানিকটা হাওয়া পেলাম, একটু নড়ে চড়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বসলাম।

উনি ইংরেজিতে ব্লগান, স্বনামে এবং বেনামে, দু'ভাবেই। বেশ সুপরিচিত একটা গ্রুপ-ব্লগ। ইংরেজি ব্লগগুলোয় আমার যাতায়াত একেবারেই কম- যদি না কেউ খুব নির্দিষ্ট করে কোন পোস্টের রেফারেন্স দেয়। আর উনিও বাংলা ব্লগে খুব একটা ঘোরাফেরা করেন না। অবশ্য সচলায়তনের কথা জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, পড়েছেন অনেক লেখা। বিশেষ আগ্রহী ছিলেন বটু মিয়ার বৈঠকখানার প্রতি।

ঠিক তুলনা নয়, আমরা এমনিতেই নিজ নিজ ব্লগের গল্প করছিলাম।

ব্লগিং কনসেপ্টেও সচলায়তনের সাথে ওনাদের ভিন্নতা টের পেলাম। এখানে আমরা ব্লগেই লিখি, এখানেই খোলামেলা মন্তব্য চলে। এইসব সমালোচনার প্রভাবে লেখার পরিমার্জনাও ঘটে ক্ষেত্রবিশেষে।
কিন্তু ওনাদের ইংরেজি ব্লগে মন্তব্য-সমালোচনার পুরো ব্যাপারটি হয় ইমেইলের মাধ্যমে। সেখান থেকে ফিডব্যাক নিয়ে সুন্দর ঘষামাজা শেষে যে লেখাটা দাঁড়ায়, সেটাই উঠে আসে ব্লগে। অর্থাৎ ব্লগ মূলত প্রকাশমাধ্যম হয়ে উঠেছে। সচলায়তনের 'লেখক ফোরাম' ধরনের ব্লগীয় কনসেপ্টের চেয়ে অনেক আলাদা, তবে এই ভিন্নতাটুকু অস্বাভাবিক মনে হলো না আমার কাছে।

গল্পের এক পর্যায়ে চা-এর যোগান দেয়া হলো, সেই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কথা বেড়েই চললো রাত আরো গভীর করে।

সম্প্রতি ওনাদের ইংরেজি ব্লগের পাশাপাশি একটা বাংলা ব্লগও রান করছে। ব্যাপারটা জানার পর আমি আগ্রহ নিয়ে দেখেছি কদিন সেটা। বেশ ভাল ভাল লেখা আসছে। এবং দেখেছি বিখ্যাত সব লেখকেরা, মূল মিডিয়ায় পরিচিত যারা- তাঁরাও লিখছেন ওখানে। শুরুতে আমি ভেবেছিলাম, এটা বেশ ভালো হলো তো, এরকম লম্বা দৈর্ঘ্যের লেখকেরা যদি সত্যিই ব্লগানো শুরু করেন তো বেশ হয়। কিন্তু সেই সব লেখার মন্তব্যের ঘরে লেখকদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ে নি, এবং না পড়ায় বিস্মিত হয়েছি। শেষ মেষ পুরো ব্যাপারটাই পত্রিকার কলাম সংগ্রহের মতন হয়ে দাঁড়িয়েছে- ঠিক ব্লগ আর হয়ে ওঠে নি।

এই নিয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলাম- সেই সব নামী লেখকেরা কি সত্যিই ব্লগান-, নাকি তাঁদের পক্ষ থেকে লেখা আপলোড করা হয়?

আশংকা সত্যি হলো। জানলাম, বেশিরভাগ লেখকদেরই লেখা সংগ্রহ করা হয় লোক মারফত, তারপরে ওখানে তুলে দেয়া হয়। লেখকেরা নিজেরা ব্লগান নি এখনো।
বলতেই হয়, বেশ খানিকটা দমে গেলাম আমি এ কথা শুনে।
মনে হলো, সচলায়তন এদিক দিয়ে বেশ আলাদা, উল্লেখযোগ্য লেখকদের আমরা এখানে ব্লগার হিসেবেও পেয়েছি। ওনারা অন্যদের ব্লগ পড়েন, মন্তব্য করেন এবং নিজেদের ব্লগে আসা মন্তব্যের প্রতি উত্তর দেন।

আলাপে আলাপে রাত আরো বাড়তেই উঠবার তাড়া এলো।
পুরো সময়টুকুই বেশ ভালো লাগলো আমার। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতদের সান্নিধ্যে আসা ছাড়াও- অনেকদিন বাদে এরকম নিষ্কলুষ কিছু আড্ডা দিতে পারলাম। আড্ডায় এরকম একজন ব্লগারের দেখা পেয়েও আমি বেশ আনন্দিত- খুব ভালো লাগলো ওনাকে। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে বেশ মজার কিছু আগে-শোনা-কৌতুকও আবার শুনে প্রাণ খুলে হাসলাম। বলার ভঙ্গিতে আন্তরিকতা না থাকলে এরকমটা সম্ভব হতো না।

তো সেই আড্ডা শেষে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমার মনে হলো, সেই দিন আসলেই খুব দূরে নয়, যখন নাম-ঠিকানা-স্কুল কিংবা শহরের নামের সাথে সাথে নিজ নিজ ব্লগের ঠিকানাও প্রাথমিক পরিচিতির একটা অংশ হয়ে দাঁড়াবে।
জয় বাবা ব্লগোনাথ।

Popular posts from this blog

The Boy, the Mole, the Fox and the Horse | Charlie Mackesy

মধ্যাহ্নভোজ | উইলিয়াম সমারসেট মম্‌ | রূপান্তরঃ তারেক নূরুল হাসান

আরেকটিবার-